এ এইচ সেলিম উল্লাহ :: ‘থাকা, খাওয়াসহ সব কিছু পেলেও স্বজন হারানো বেদনা ভুলতে পারছে না উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত অনাথ রোহিঙ্গা শিশুরা। শিশুবান্ধব কেন্দ্রে লেখাপড়া, খেলাধোলা করে সময় পার করলেও তাদের বার মনে পড়ছে মা, বাবা, ভাই বোন হারানো হাজারো স্মৃতি। কেউ কেউ জানে না, তাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনদের কে কোথায় আছে। এসব শিশুদের অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রওনা হয়েছিল বাংলাদেশের পথে। কিন্তু পথেই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবার থেকে। তবে তাদের বড় অংশই রাখাইন থেকেই হারিয়েছে স্বজনদের সবাইকে। মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয়, ইয়াছির আরফাত (৯) সাথে। ঠিক ভাবে কথা বলছে না মানসিক বিপর্যন্ত ইয়াছির। নিজের গ্রামের নামটাও ঠিকমতো বলছে পারছেনা সে। রাখাইনের ওয়াবেক এলাকার ছৈয়দ উল্লাহ পুত্র ইয়াছির। চোখের সামনে বাবা-মাকে কেটে ফেলেছে। তাদের হুজুরকে শুদ্ধ কেটে ফেলেছে বলে জানায় সে। ছোট এক বোনকে নিয়ে বর্তমানে থাকে দাদা-দাদির সাথে থাকে। আয়াত উল্লাহ (৬) মিয়ানমারের বলিবাজার ধুমবাই এলাকা থেকে বাবা শামসুল আলমের হাত ধরে পালিয়ে এসেছে। চোখের সামনে মা দিলবাহারকে বার্মিজ সেনারা পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে মেরে ফেলতে দেখেছে সে। এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি সে। প্রায়ই কান্নাকাটি করে। তার মতো অনেক শিশুর একই অবস্থা। এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া অনাথ শিশুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাবা মা হারিয়ে অনাথ শিশুদের আশ্রয় হয়েছে বিভিন্ন ক্যাম্পে। এসব অনাথ শিশুদের তালিকা তৈরির কাজ করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২০ হাজার ৭৭০ জন রোহিঙ্গা এতিম শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মীরা ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে খুঁজে খুঁজে অনাথ শিশু শনাক্তকরণের কাজ করছেন। যারা বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে, যারা শুধু বাবা হারিয়েছে, যারা প্রতিবন্ধী, আর যারা মা-বাবার খোঁজ পাচ্ছে না- এমন চারটি শ্রেণিতে এদের ভাগ করা হচ্ছে। শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সী পর্যন্ত শিশুদের হিসেবে গণনা করে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী বলেন, শনাক্ত হওয়া এতিম শিশুদের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। ” তিনি জানান, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের সংখ্যা ২৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।
আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার শিশু মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটি জানায়, শিশুরা পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সেবার সংকটে রয়েছে। সেখানে ডায়রিয়া, কলেরাসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি খুবই বেশি। তাছাড়া শিশুরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়লে তাদের আরো বড় বিপদ হতে পারে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম বলেন, ‘‘শিশুরা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচেছ। তাদের অধিকাংশ চর্মরোগেও আক্রান্ত এবং দীর্ঘ পথ হেটে আসায় শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্যাম্প গুলোতে আলাদা ভাবে শিশুদেরকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে সাধ্যমত। ”
কোডেকের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো: নাসির উদ্দিন বলেন, উখিয়া-টেকনাফে ১৬টি শিশু বান্ধব কেন্দ্র করে এতিম এবং সাধারণ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। ইউনিসেফ এর অর্থায়নে কোডেক তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।
সরেজমিন কুতুপালং-১ শিশু বান্ধব কেন্দ্রে শিশুদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। শিশুদের আনন্দে কোলাহল। একেক জন এক এক ধরণের খেলাধুলার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত। অনেককে ছবি আকঁছে। সেন্টার ম্যানেজার ছদরুল আলম বলেন, প্রতিদিন নতুন নতুন শিশুরা আসছে। এর মধ্যে এতিম শিশুও আছে। এ পর্যন্ত ২০জন এতিম শিশু পাওয়া গেছে। তাদের আলাদা ভাবে যতœ নেয়া হচ্ছে।
কোডেকের স্থায়ী শিশু বান্ধব কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন খেলাধুলার সরঞ্জাম নিয়ে ক্যাম্পের বিভিন্ন গলিতে গলিতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ টীমের মাধ্যমে আশ্রিত শিশুদের মানসিক বিকাশে কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্যোসাল ওয়ার্কার সোহেল আরমান।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের সুরক্ষার জন্য ‘শিশুপল্লী’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে উখিয়ার নিবন্ধিত কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধুছড়া এলাকায় ২০০ একর জমিও নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সম্মেলন কক্ষে রোহিঙ্গা বিষয়ক সমন্বয় কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকে এতিম হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসব শিশুকে বিশেষ একটি সুরক্ষা অঞ্চলে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।