হাওরে ফসলের ক্ষতির প্রভাব চালের বাজারে দৃশ্যমান হচ্ছে। হাওর থেকে বোরোর প্রথম ধান বাজারে আসেনি এবার, তাই বাড়ছে ধান-চালের দাম। দামের এই ঊর্ধ্বগতিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে চালকলের মালিকেরা সরকারি গুদামে ধান-চাল দিতে রাজি হচ্ছেন না। চালকলের মালিকেরা সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার চুক্তি পর্যন্ত করতে রাজি হচ্ছেন না; বরং সংগ্রহমূল্য বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা।
বাজারে প্রতি কেজি চালের পাইকারি মূল্য এখন ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। আর সরকার প্রতি কেজি চালের সংগ্রহমূল্য ঠিক করেছে ৩৪ টাকা। সুতরাং খোলাবাজারে চাল বিক্রি করলেই তো বেশি লাভ।
গুদামে চাল না আসায় সরকারি মজুতও ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে গিয়ে ঠেকেছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল ছিল আড়াই লাখ টনের বেশি। গত বছর একই সময়ে চাল ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার টন।
এরই মধ্যে মোটা চালের দাম এখন গত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। খাদ্য অধিদপ্তর ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বাজারে মোটা চালের কেজি ৪৫ টাকায় ঠেকেছে। মোটা চালের দর গত এক মাসেই প্রতি কেজিতে তিন টাকা আর এক বছরে বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে তারা ছয় লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা করলেও পরে তা বাড়িয়ে আট লাখ টন করেছে। এর মধ্যে তারা দুই দফায় ৫০ হাজার টন করে মোট ১ লাখ টন চাল আমদানির আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে চাল আমদানির ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। এর মেয়াদ আরও পাঁচ বছর নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কায়দাবাদ হোসেইন ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে চিঠি লিখেছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বেসরকারি খাতে চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য চলতি মাসের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছিল। যুক্তি হচ্ছে, শুল্ক কমানো হলে বাজারে চালের আমদানি বাড়বে ও দাম কমবে। তারা এখন শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। তবে সরকারের তরফ থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চাল আমদানির অনুমতি মিললেও বেসরকারি খাতের জন্য আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পক্ষে সায় দেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, ধান-চালের দাম বাড়ায় কৃষকেরা অনেক দিন পর কিছুটা লাভের মুখ দেখছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ এলাকার বোরো ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। এতে এমনিতেই বাজারে ধান-চালের দাম কমে আসবে। সুতরাং বেসরকারি খাতের মাধ্যমে চাল আমদানি বেড়ে গেলে কৃষকের ভালো দাম পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল বলেন, আগামী সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে দেশের অনেক এলাকাতেই বোরো কাটা শেষ হবে। এতে বাজারে জোগান বেড়ে দাম কমবে। আর গুদামে সংগ্রহ বাড়াতে সরকারিভাবেও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে চালের আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয় চলতি বোরো মৌসুমে আট লাখ টন চাল ও সাত লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। চলতি মাসের মধ্যে ওই ধান-চাল সংগ্রহের জন্য চালকলগুলোর সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। গতকাল সোমবার পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার টন চাল সংগ্রহের জন্য চালকলের মালিকদের সঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের চুক্তি হয়েছে। চালকলের মালিকেরা এখন সংগ্রহমূল্য বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। নইলে তাঁরা সরকারকে চাল দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকারের চাল সংগ্রহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে খাদ্যসচিব বলেন, ‘সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটি (এফপিএমইউ) থেকে সংগ্রহমূল্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এই দাম আর কোনোভাবেই বাড়ানো সম্ভব নয়। এই দামে যেসব চালকলের মালিক রাজি হবেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা চুক্তি করব। আর চাল আমদানির পথও আমরা খোলা রাখছি।’
এ নিয়ে দেশের চালকলের মালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতির সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তারা প্রতিবার একই কথা বলছে, চালের সংগ্রহমূল্য বাড়াতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চালকলের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে আজ থেকে দেশের পাঁচটি জেলায় সফরে বের হচ্ছেন। আজ সৈয়দপুর ও রংপুরে চালকলের মালিকদের সঙ্গে মন্ত্রী ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তিনি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া সফর করবেন।
এ ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, ‘চালকলের মালিকদের একাংশ বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা যা-ই বলুক না কেন, আমরা ধান-চালের সংগ্রহমূল্য বাড়াব না। যেসব চালকলের মালিক বর্তমান দরে গুদামে চাল দিতে রাজি হবেন, তাঁদের সঙ্গে কীভাবে চুক্তি করা যায়, সে জন্য আমরা আলোচনা করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছি। এ ছাড়া মোট আট লাখ টন চাল আমদানির জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছি। আন্তর্জাতিক দরপত্র ও জিটুজি (রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে) চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি।’
বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৬০০ চালকল রয়েছে। বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় বেশির ভাগ চালকলের মালিক ধান কেনা শুরুই করেননি। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালকলের মালিকেরা বলছেন, এই দামে ধান কিনে তা ভাঙিয়ে চাল করে বাজারে বিক্রি করে তাঁদের পোষাচ্ছে না। ফলে গত আমনের সময় মজুত থাকা ধান দিয়ে ৫০০ চালকল চালু রয়েছে, বাকি চালকলগুলো বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ রাইস অটো, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতির সভাপতি লায়েক আলী বলেন, ‘বাজার থেকে ধান কিনে তা ভাঙিয়ে সরকারি গুদামে চাল দিতে গেলে প্রতি কেজিতে তিন থেকে চার টাকা লোকসান হবে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের অসহায়ত্বের কথা সরকারকে জানিয়েছি। আজ খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা বলব।’
সরকার পর্যাপ্ত চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হলে কী হবে—এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মে মাসের মধ্যে সরকারি মজুত বাড়াতে না পারলে বেশির ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে হাওর এলাকায় আগামী এক বছর খাদ্য সরবরাহের অঙ্গীকার করেছে সরকার। কিন্তু গুদামে যথেষ্ট চাল না থাকায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চাল সরবরাহ কমে এসেছে। চলতি মাসের শুরুতে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বিভিন্ন খাতে ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন চালের প্রয়োজন হবে। গুদামে চাল না এলে ওই চাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।