বহুল আলোচিত সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৭-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তবে সরকারি কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) গ্রহণের আগে তাকে গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কারণে কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে সরকার তার দায় নেবে না। এ ক্ষেত্রে চার্জশিটের আগে তাকে গ্রেফতার করতে সরকারের অনুমতি নেওয়া লাগবে না। আইনটি অনুমোদনের জন্য আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে তা আরও পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করতে ফেরত দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনটির বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেন। এসব নির্দেশনা সংযুক্ত করে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ আইনটি বাস্তবায়ন হলে বিদ্যমান ছয়টি আইন ও অধ্যাদেশ রহিত হবে। এগুলো প্রস্তাবিত আইনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে_ সরকারি কর্মচারী অবসর আইন, কর্মচারী
পুনর্গঠন ও শর্তাধীন অ্যাক্ট, কর্মচারী স্পেশাল প্রভিশন অ্যাক্ট, নিয়মিত উপস্থিতি অধ্যাদেশ, আদালতে রায়ের মাধ্যমে চাকরি নিষ্পত্তিকরণ অ্যাক্ট এবং উদ্বৃত্ত সরকারি কর্মচারী আইন। এ আইন ও অধ্যাদেশগুলোর সব বিধানই প্রস্তাবিত কর্মচারী আইনেই যুক্ত হবে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব সমকালকে বলেন, আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এটি সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি মাইলফলক। তিনি জানান, ফৌজদারি মামলা হলে কর্মচারীদের গ্রেফতারে সরকারের অনুমোদন লাগবে বলে ধারাটি স্পষ্ট করা রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, সরকারি কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে চার্জশিট গ্রহণের আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই।
সূত্র জানায়, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এই বিশেষ সুবিধাটি অন্য কোনো পেশার ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এমনকি মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষেত্রেও নয়। সাংবিধানিক পদে ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, পোশাকধারী শৃঙ্খলিত যে কোনো বাহিনী, রেলওয়ের কর্মচারী, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ আইনের আওতায় পড়বেন না তাদের নিজস্ব আইন থাকায়।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী আদালতে দণ্ডিত হলে তাকে চাকরিতে বহাল রাখার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। কারও বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তা যদি আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করা যাবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কোনো কর্মচারী যে কোনো সময়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে পারবেন। সরকার তা নির্ধারণ করবে কীভাবে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। চলতি নিয়মে ২৫ বছরের আগে কেউ চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারতেন না।
কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন বিধি নির্ধারণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে মেধা ও জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে কর্মচারীদের দাবি ছিল, পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান চালু করা। খসড়া আইনে সে বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি। চিরাচরিত নিয়মই রাখা হয়েছে এ ক্ষেত্রে। খসড়ায় সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৯ বছরই রাখা হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের জন্য রাখা হয়েছে ৬০ বছর। এ ছাড়া কর্মচারীদের নিয়মিত উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আইনে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তারা ছুটি ভোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া কেউ দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কেউ তাকে দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে।
২০১৫ সালের ১৩ জুলাই সরকারি কর্মচারী আইন মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সময় খসড়ায় ফৌজদারি কোনো মামলায় সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রাখা হয়। এতে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় আইনটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রায় এক বছর পর্যালোচনা শেষে আইনটির কয়েকটি ধারা আরও স্পষ্ট করে পাঠাতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়। পরে ওই মন্ত্রণালয় কয়েক দফা বৈঠক করে ধারাগুলো স্পষ্ট করে খসড়া চূড়ান্ত করে।
স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সাংবিধানিক অঙ্গীকার ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ কোনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি। বিভিন্ন সরকারের মনগড়া বিধিমালা দিয়ে চলেছে পুরো প্রশাসন। আর এ বিধিমালার অজুহাতে প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বিগত সরকারগুলো, যার ফলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। সর্বদা প্রশাসনের একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ, অসন্তোষ বিরাজ করেছে। তাদের কাজকর্মেও অনীহা লক্ষণীয়। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে প্রশাসনযন্ত্র। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। এমনকি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও প্রশাসনের একই চিত্র দেখা গেছে। প্রশাসনকে গতিশীল করার সরকারের কোনো উদ্যোগ কাজ দেয়নি। প্রশাসনে স্থবিরতা ও আস্থাহীনতা নীরবে বিরাজ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রশাসনকে গতিশীল করতে সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআরের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এসিআরের নম্বর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজের এসিআর নম্বর সঙ্গে সঙ্গেই জেনে নিতে পারবেন। কোনো অনিয়ম থাকলে তা নিরসনে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।