২০১৩ সালের ৫ মে। গোটা রাজধানী যেন একটি রণক্ষেত্র। আগুন জ্বলছে রাজধানীর বাইরেও। হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের হামলা, ভাঙচুর, জ্বলাও-পোড়াও তাণ্ডবে বিস্মিত হয়ে পড়ে জাতি। একদিকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির মুহুর্মুহু গুলিতে কাঁপছে রাজধানী। অন্যদিকে হেফাজতের হুঙ্কারে কাঁপছিল সরকার।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মসনদে বসার পর কখনও এমন চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি। বাধ্য হয়ে রাতে পরিচালিত হয় সাঁড়াশি অভিযান। সরকারি বাহিনীর কৌশলী অভিযানে পিঁছু হটল হেফাজত। হেফাজতের করা ঘোলা পানিতে যারা মাছ শিকার করতে চাইলেন, সে মাছ অধরাই রয়ে গেল।
এরপরের ঘটনা সবার জানা। হেফাজতের তাণ্ডব, সরকারের অবস্থান সবই যেন ইতিহাস! প্রায় জাদুঘরে গিয়ে ঠেকেছে হেফাজতের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড।
একসময় হেফাজত-সরকারের সম্পর্ক নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও তারা যে আজ পরমমিত্র, তা অনেকটাই পরিষ্কার। হেফাজত এখন সরকারের পথনির্দেশক! যে হেফাজতের কর্মকাণ্ডে বিব্রত ও সমালোচনামুখর ছিল সরকারের লোকেরা, সেই হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে।
হেফাজতের একসময়ের বন্ধু খালেদা জিয়া তাদের (ইসলামি দল) কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির আবদার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই আবদার লুফে নিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এখানেই শেষ নয়। হেফাজতের সুরে সুর মিলিয়া প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের সামনে বসানো ভাস্কর্য তার পছন্দের নয় বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেও হেফাজতের আশীর্বাদ পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন সরকারের মধ্যে থাকা বামপন্থি নেতারাও। সামনে নির্বাচন। গঙ্গার পানি গড়িয়েছে বহু দূর। হেফাজত ভয়ে মসনদের কাঁপুনি হয়তো আজও থামেনি। নির্বাচন ঘিরে হেফাজতের প্রতি সরকারের এ সখ্যতা বলে বিভিন্ন মহলের মত। নির্বাচন ঘিরেই বিএনপি-জামায়াতের কাছে ২০১৩ সালে কদর বেড়েছিল হেফাজতের। এবার কদর বেড়েছে আওয়ামী লীগের কাছে।
সরকারের নকশায় আর অনুগ্রহে থাকা ‘গণজাগরণ’ নামের সংগঠনের দেওয়ালের বিপরীত পিঠে জন্ম নেয়া ‘হেফাজত’ সরকারের এভাবে বন্ধুবনে যাবে, তা খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যকার নেতাদেরও কেউ কেউ মানতে চাইছেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হেফাজত সরকারের কাছে এসেছে সুবিধা নিতে। দলটির আদর্শ ও নীতি সবই ১৯৭২ সালের সংবিধানের পরিপন্থি। আওয়ামী লীগ এভাবে হেফাজতের ফাঁদে পা দিলে আর রক্ষা পাবে না। সুযোগ পেলেই হেফাজত ডিগবাজি দেবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ যে সুবিধা নিতে হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাতে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ ডেকে আনবে। হেফাজত কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির বন্ধু হতে পারে না।
যদিও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতা হয়নি।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে আর কোনো দলকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। ভোটের রাজনীতি নিয়ে হেফাজত বা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতা হয়নি আমাদের। হেফাজতের চেতনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের চেতনা সম্পূর্ণ আলাদা।’
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকও প্রায় একই সুরে বলেন, ‘রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা এগিয়ে নিতে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় সম্পৃক্তের চেষ্টা করছে সরকার। এখানে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো প্রশ্ন আসতে পারে না।’
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম সম্পূর্ণ একটি অরাজনৈতিক দল। সুতরাং রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে না।’
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিতে যা কোরআন-সুন্নাহবিরোধী, তাই নিয়ে আন্দোলন করছি, সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। সরকার আমাদের দাবি না মানলে ভবিষ্যতেও আন্দোলন করা হবে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।