হুমায়ুন সিকদার:
সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হচ্ছে কুতুবদিয়াবাসী। দীর্ঘ ৫-৬ শ বছর ধরে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সুবিধার থেকে বন্ঞিত জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপ। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রায় দেড়লাখ জনসংখ্যা ২১৫ বর্গমাইল আয়তনের এ উপজেলায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ যাবে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। এজন্য ৮০ কোটি টাকার প্রকল্প পাশ হয়েছে গতবছরের জুন মাসে । চলতি বছরের শুরুতে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারিতে পিছিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রাচীন এই জনপদের মানুষ পুরোপুরি বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে।
কুতুবদিয়া – মহেশখালীর সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক জানান, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ স্হাপনে পিডি নিয়োগ, সার্ভে করাসহ প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন। চলতি বছরে কাজ শুরু হওয়ার কথা কিন্তু করোনা ভাইরাস জনিত কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। পরিস্হিতি স্বাভাবিক হলে আগামী বছর নাগাদ কাজ সম্পন্ন হতে পারে বলে আশান্বিত তিনি।
কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এড ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ স্হাপনের কাজ শেষ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এতোদিনে দ্বীপবাসী বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে যেতো। করোনা মহামারির অবস্থা ভালো হলেই কাজ শুরু হবে বলে ও জানান তিনি।
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জিয়াউল হক মীর জানান, বিষয়টি অবগত হয়েছি, পরিস্থিতি অনুকূলে হলে শিগগিরই কাজ শুরু হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপবাসী সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছে।
১ যুগ আগে বায়ু বিদ্যুৎ প্যানেল স্হাপন করে ওই দ্বীপ উপজেলায়।
দ্বীপ রক্ষায় সরকার বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে কাজ সম্পন্ন না হওয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।
বিদ্যুৎ সংযোগ, ফেরি সার্ভিস চালু ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের বলে জানান কুতুবদিয়া উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হলে এখানে শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এলে লবণ পরিশোধন শিল্প, মৎস্য-চিংড়ি ও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, গভীর সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ও বরফ কলসহ আরও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। কুতুবদিয়া দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে বিস্তৃত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে সমুদ্রসৈকত ও দৃষ্টিনন্দন ঝাউবন।
বিদ্যুৎ সুবিধা পেলে এখানে আধুনিক হোটেল, মোটেল, কটেজ ও পর্যটন উপযোগী অন্যান্য স্থাপনা গড়ে উঠবে। এর ফলে অবহেলিত দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রার সার্বিক মানোন্নয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জানাযায়, কুতুবদিয়া উপজেলায় বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে ৮ মেগাওয়াট।
বর্তমানে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অল্পসংখ্যক মানুষ উপকৃত হলেও অধিকাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
ইতিহাস থেকে জানাযায়, দীর্ঘদিন ধরে কুতুবদিয়া দ্বীপের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও এ দ্বীপ সমুদ্র বক্ষ থেকে জেগে উঠে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ধারণা করা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ দ্বীপে মানুষের পদচারণা। হযরত কুতুবুদ্দীন নামে এক কামেল ব্যক্তি আলী আকবর, আলী ফকির, হাতিয়াসহ কিছু সঙ্গী নিয়ে মগ পর্তুগিজ বিতাড়িত করে এ দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। অন্যদিকে আরাকান থেকে পলায়নরত মুসলমানরা চট্টগ্রামের আশপাশের অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে ওই দ্বীপে আসতে থাকে। জরিপ করে দেখা যায়, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পটিয়া, চকরিয়া অঞ্চল থেকে অধিকাংশ আদিপুরুষের আগমন। নির্যাতিত মুসলমানরা কুতুবুদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধান্তরে কুতুবুদ্দীনের নামানুসারে এ দ্বীপের নামকরণ করেন কুতুবুদ্দীনের দিয়া, যা পরবর্তীকালে কুতুবদিয়া নামে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে এই দ্বীপে বসবাস শুরু করে।
বর্তমানে এই দ্বীপের বসতি ৫ শ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দ্বীপের আয়তনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এখনো সাগরের ঢেউয়ের প্রভাবে ভেঙে সমুদ্রে পরিণত হচ্ছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা কুতুবদিয়া দ্বীপটি।
জানা গেছে, পিডিবি বিতরণ চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের গৃহীত ২৬০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের মধ্যে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ প্রকল্পটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।। এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা মিটানো সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প-২’ নামে এই মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২৫টি নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ, ১৫টি সাবস্টেশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ৮০০ কিলোমিটার ১১ কেভি বিদু্যৎ লাইন স্থাপন এবং সাড়ে ৫ হাজার উন্নতমানের ট্রান্সফরমার বসানো হবে। এছাড়া ৪৯৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার ৩৩ কেভিএক্সএলপিই, ৩০ কিলোমিটার ৩৩ কেভি এক্সএলপিই এবং ৩১ কিলোমিটার ১১ কেভি এক্সএলপিই আন্ডারগ্রাউন্ড কপার ক্যাবল স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনো ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লোডশেডিং থাকবে না। ২০২২ সালের জুনে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট লোড কাভার হবে। এখন চট্টগ্রামের চাহিদা ১৩০০ মেগাওয়াট হলেও ২০৩৫ সালে চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট। ওই সময়ের লোড ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগীভাবে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।