নিয়ন্ত্রক সংস্থা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ২১৩। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৫১ হাজার ২৮০। সরকারি তথ্যানুযায়ী, গাড়ির তুলনায় চালকের ঘাটতি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৩ জন। এ বিপুল সংখ্যক যানবাহন চালায় কারা? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভুয়া লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা চালাচ্ছে ১০ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৩টি নিবন্ধিত যানবাহন।
লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা সাড়ে ১৯ লাখ হলেও, গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছে ১৩ লাখ ২৪ হাজার ১৩৭ জন। বাকিরা এখনও স্মার্টকার্ড নেয়নি। তাদের বড় অংশই আর পেশায় নেই। নারী-পুরুষ মিলিয়ে স্মার্টকার্ডধারী পেশাদার চালকের সংখ্যা সাত লাখ ৫৯ হাজার ৬২৬। প্রায় ৩০ লাখ যানবাহনের মধ্যে
প্রাইভেটকার, জিপ ও মোটর সাইকেল বাদে বাকিগুলো বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এমন যানবাহনের সংখ্যা আট লাখ ১৫ হাজার। চালকের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি। প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রাইভেটকারের একটি বড় অংশই চলে পেশাদার লাইসেন্সধারী চালকের হাতে। এ হিসাবে যানবাহনের তুলনায় চালকের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে জানান পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিআরটিএর হিসাবে, ভারী যানবাহন এক লাখ ৯১ হাজার ৭৬টি। সংস্থাটির উপপরিচালক মাসুদ আলম জানান, বাস, ট্রাক, ট্যাংকার এবং পণ্যবাহী প্রাইম মুভার ও ট্রেইলারকে ভারী যানবাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিবন্ধিত ভারী যানবাহনের মধ্যে বাসের সংখ্যা ৪০ হাজার ৯৩৫। ট্রাক রয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ১৭১টি। কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ২১ হাজার ৩৫৪। নিবন্ধিত প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার পাঁচ হাজার ১০৩টি।
পরিবহন মালিক সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, প্রতিটি ভারী যানে অন্তত দু’জন চালক প্রয়োজন। এ হিসাবে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৬টি ভারী যানবাহনের জন্য চালকের প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ ৯২ হাজার। কিন্তু ভারী যানবাহনের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ২ লাখ ৩৮ হাজার ৭২১ জন। চালকের ঘাটতি প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার।
রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, তিন দফা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বাসের জন্য যোগ্য চালক পায়নি বিআরটিসি। কারণ, বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের অভাব। রফিকুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসির দেড় হাজার বাসের জন্য তিন হাজার চালক প্রয়োজন। কিন্তু কর্মরত আছে মাত্র ১ হাজার ৬০০ জন।
উপপরিচালক মাসুদ আলম জানান, তিন বছর মধ্যম মানের যান অর্থাৎ মিনিবাস, মিনি ট্রাক, পিকআপ চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা আবেদন সাপেক্ষে ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স পায়। মিনিবাস, পিকআপ ও মিনি ট্রাককে মধ্যম মানের যান হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়। বিআরটিএর হিসাবে, মধ্যম মানের নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যায় ঘাটতি আছে মধ্যম মানের যানবাহনের চালকের ক্ষেত্রে। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মধ্যম মানের যানবাহনের সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ৬১২। এ শ্রেণিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ৬৮ হাজার ২১৬। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার চালক ঘাটতির কথা বলেছেন। গত রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ঘাটতি দূর করতে প্রশিক্ষিত চালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই অনুষ্ঠানে পরিবহন নেতারাও চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার দাবি তোলেন।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদু বলেন, লাইসেন্স ইস্যুতে শুধু চালক-শ্রমিকদের একতরফা দোষ দেওয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করতে পর্যাপ্ত উদ্যোগই নেই। লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও ত্রুটি রয়েছে। ১০ বছর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকার পরও অনেকে লাইসেন্স পায় না।
দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেরও ঘাটতি রয়েছে। সারাদেশে বিআরটিএ অনুমোদিত ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৯৮। এর মধ্যে ১৭টি বিআরটিসির। বাকিগুলো বেসরকারি। বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান জানান, দক্ষ চালক তৈরি করতে তারা কাজ করছেন, প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিআরটিএ নানা উদ্যোগের কথা বললেও সবচেয়ে চালকের ঘাটতি রয়েছে ছোট যানবাহনের ক্ষেত্রে। মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যানবাহন এক প্রকার লাইসেন্সবিহীন চালক ছাড়াই চলছে। নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৮ লাখ চার হাজার ৮৩৪। লাইসেন্সধারী মোটরসাইকেল চালক মাত্র ছয় লাখ ৯৩ হাজার ৫৭৫ জন। প্রায় ১১ লাখ মোটরসাইকেল চলছে বৈধ চালক ছাড়াই। একই অবস্থা তিন চাকার যানের বেলায়ও। নিবন্ধিত তিন চাকার গাড়ি দুই লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৯টি। লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৬৭৩।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী তার সংস্থার প্রতিবেদনের বরাতে জানান, সারাদেশে ইজিবাইক, নছিমন-করিমন-ভটভটিসহ অনিবন্ধিত তিন চাকার যানবাহন রয়েছে ১৪ লাখের বেশি। এগুলো কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়াই চলছে। লাইসেন্স ছাড়াই এসব অনিবন্ধিত যানবাহন চলছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।