বাংলাদেশে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক পাচার করে প্রতিবছর অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে মিয়ানমার। এরমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকারী মাদক ব্যবসায়ীরা করছে আরো প্রায় সমপরিমাণ ব্যবসা। এভাবে মিয়ানমার ভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফেলছে কালো ছায়া। বর্তমানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পাহাড়ী এলাকায় গড়ে ওঠেছে অন্তত ৩৭টি অবৈধ ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানায় ভারত ও বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সিউডোফেড্রিন দিয়েই মেটাফেটামিন তৈরি করে এর সাথে ক্যাফেইন মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট আর ফের ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার সিউডোফেড্রিন আমদানি বন্ধ করতে যাচ্ছে। ইয়াবা পাচার কমিয়ে আনতে চলতি মাসে মিয়ানমার সফরেও যাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
তবে মিয়ানমারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের দাবি, ভারতে অনিয়ন্ত্রিত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে সিউডোফেড্রিন উৎপাদন করছে এবং তা পাচার হয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করছে। আর তা দিয়েই তৈরি হচ্ছে ইয়াবা।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও সাম্প্রতিককালে এ ধরনের পাচার বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে সিউডোফেড্রিন আমদানি ৬ গুণ বেড়ে গেছে। এই ওষুধের পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের সন্দেহভাজন শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়স্থানে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অথরিটি (ডিইএ)। ওই অথরিটি ২০১৪ সলে এ তথ্য প্রকাশ করার পর এদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে এবং শতাধিক ইয়াবা পাচারকারীর একটি তালিকা তৈরি করে। পাশাপাশি সিউডোফেড্রিন আমদানি নিষিদ্ধ করার একটি প্রস্তাবও পেশ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈধভাবে ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, ইতালি ও ব্রাজিল থেকে সিউডোফেড্রিন আমদানি করে। আমদানি করা সিউডোফেড্রিন দিয়ে ওষুধ কোম্পানীগুলো আট প্রকারে ওষুধ তৈরি করে।
মাত্র এক দশক আগেও কক্সবাজারসহ সারাদেশে কালেভদ্রে এক চালানে ইয়াবা ধরা পড়ত বড়জোর কয়েকশত পিস। এখন প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ে লাখে লাখে। এভাবে অবৈধ মাদক ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সমাজের উচ্চস্তর থেকে নি¤œস্তর পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছে এমন অবৈধ ব্যবসায়। আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এরা দেশে চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার রাজধানী ঢাকায় কক্সবাজারের প্রথম সারির এক যুবদল নেতা এক লাখ পিস ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে। এর আগেও দেশের বিভিন্নস্থানে কক্সবাজারের যুবদল-ছাত্রদল, ছাত্রলীগ-যুবলীগ, মৌলভি, ভান্তে, সংবাদকর্মী-মানবাধিকার কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ইয়াবাসহ আটক করেছে। এমনকি কক্সবাজারের একজন এমপি এবং তার আত্মীয়স্বজনেরাও সরকারের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বার্ষিক ইয়াবা ব্যবসার পরিমাণ ৩ হাজার মিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে; যেগুলো আসছে মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে। এছাড়া বাংলাদেশে বিয়ার ও মদ পাচার করে মিয়ানমার আরো অন্তত এক হাজার কোটি টাকা আয় করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা নয় ভাগের উপরে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ মাদকের ব্যবসা থেকে আসছে বলে বিভিন্ন মহল ধারণা করছে। বর্তমানে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় ও উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর প্রধান বাণিজ্যের অবস্থান দখল করেছে মাদক ব্যবসা। এই সেক্টরের মধ্যে ইয়াবা থেকেই আসছে সিংহ ভাগ টাকা। বাংলাদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ ইয়াবা টেবলেট সেবন করা হয়। মিয়ানমার সীমান্তের দূর্গম অঞ্চলে এসব টেবলেট উৎপাদন করা হয়, সেব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি অনেক কম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এক কেজি সিউডোফেড্রিনের বর্তমান বাজারমূল্য ৬৭ ডলার বা প্রায় ৫ হাজার টাকা। এই পরিমাণ সিউডোফেড্রিন দিয়ে তৈরি করা সম্ভব ৪ লাখ পিস ইয়াবা টেবলেট। যার বর্তমান বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১২ কোটি টাকা। এ কারণে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সিউডোফেড্রিন অপব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কেমিস্ট দুলাল কৃষ্ণ সাহা।
তবে তিনি অবৈধপথে সিউডোফেড্রিন পাচারের সঙ্গে জড়িত কোন কোম্পানিকে চিহ্নিত করা যায়নি বলে জানান।
সিউডোফেড্রিনের আমদানি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সিনিয়র অফিসার নজরুল ইসলাম শিকদার বলেছেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে মিয়ানমারসহ কোনও প্রতিবেশী দেশই অভিযোগ করতে পারবে না যে, বাংলাদেশ ইয়াবার আখড়া।’
উল্লেখ্য, ফুসফুস, কান ও গলার প্রদাহ এবং সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জি উপশমের ওষুধে সিউডোফেড্রিন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ২০টি ব্র্যান্ড টেবলেট ও সিরাপ পাওয়া যায়। তবে এর সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়েই তৈরি করা হচ্ছে মাদকদ্রব্য। বিশ্বজুড়েই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি মাদকের জন্য কুখ্যাত দেশ মেক্সিকোও সিউডোফেড্রিন আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।
সূত্রঃ দৈনিক কক্সবাজার
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।