সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকায় আতিয়া মহল ঘিরে চালানো অভিযান অপারেশন টোয়াইলাইটের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। টানা চার দিন অভিযান চালানো শেষে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভবনটি পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবনের ভেতর থাকা দুই জঙ্গির মরদেহও পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযানে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে একজন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা বলে ধারণা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে গত সোমবার উদ্ধার করা দুই জঙ্গির মরদেহ ঝলসে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। পরিচয় নিশ্চিত হতে তাদের ডিএনএর নমুনা এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। গতকাল ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নারীটির মৃত্যু হয়েছে আগুনে। আর পুরুষটি মারা গেছে বিস্ফোরণে।
জঙ্গি আস্তানা ঘিরে স্মরণকালের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ অভিযান। গতকাল রাত ৭টা ৫৩ মিনিটে সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে
প্রেস ব্রিফিংয়ে অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা দেন সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তিনি অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে বলেন, এ অভিযান সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে।
এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পুলিশের একটি সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযানে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গি লুকিয়ে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর ২৪ মার্চ রাতে পুলিশ আতিয়া মহল ঘিরে ফেলে এবং আতিয়া মহলের নিচতলার ফ্ল্যাট বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি নিচতলার কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে জঙ্গিরা ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে এবং মূল ভবনের ফটকে বিশাল আকৃতির বিস্ফোরক স্থাপন করে। এমনকি একটি মোটরসাইকেল ও ফ্রিজে এবং ভবনের সিঁড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক লাগিয়ে পুরো ভবনটিকে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক করে ফেলে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, ইতিমধ্যে সোয়াত ঘটনাস্থলে এসে তাদের পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি বিবেচনায় সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার আলোকে সেনাবাহিনী অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। কমান্ডোরা জীবন বাজি রেখে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ২৫ মার্চ দুপুর ১টার মধ্যে ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন নারী এবং ২১ শিশুসহ ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করেন। এ পর্বটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এরপর জঙ্গিদের নির্মূল করার অভিযান শুরু হয়। এ পর্বে কমান্ডোদের পাশাপাশি স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। তিন দিন একটানা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সোমবার বিকেলের মধ্যে চারজন জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়। আরো বিশদ তল্লাশি ও নিশ্চিত হতে আজকের (মঙ্গলবার) দিনটি ব্যবহার করা হয়। সোমবার দুটি মৃতদেহ পুলিশ প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি দুটি মৃতদেহে সুইসাইডাল ভেস্টসহ থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নিরাপত্তা বিবেচনায় ও পুলিশ প্রশাসনের পরামর্শে গতকালই (মঙ্গলবার) সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের আগে প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হয়। সব কার্যক্রম শেষে বিকেলে ভবনটি ক্রাইম সিন হিসেবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং অপারেশন টোয়াইলাইটের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিকলে ৫টায় কাগজেপত্রে আমরা ভবনটি বুঝে পেয়েছি। দুই জঙ্গির লাশ এখনো ভবনের ভেতর রয়েছে। ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরকও রয়েছে। এখন বোমা নিষ্ক্রিয়কারী টিম এসে এগুলো নিষ্ক্রিয় করার পর আমরা ভেতরে যাব এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। ’
গতকাল সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ভবনটির ভেতরে থাকা বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার কাজ শুরু করে। বিস্ফোরক চিহ্নিত করতে তারা ড্রোন ব্যবহার করে। দুপুরে ওই ভবন থেকে চারটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরো চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। দূর থেকে দেখা যায়, ভবনটির চারদিকে বিশাল বিশাল গর্ত। দরজা, ভবনের পিলার ভেঙে পড়েছে, জানালার কাচও ভাঙা। বাড়িটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার করা দুই জঙ্গির মরদেহ গত সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী। গতকাল দুপুরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের চিকিৎসকদল দুই লাশের ময়নাতদন্ত করে।
পুলিশের ধারণা, মরদেহ দুটি কাউছার আলী এবং মর্জিনা বেগমের, যারা তিন মাস আগে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে আতিয়া মহলের নিচতলায় ভাড়া উঠেছিল। তবে তাদের ব্যবহৃত নাম-ঠিকানা সঠিক নয় বলেই পুলিশের ধারণা। ফলে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে তাদের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি সোহেল আহাম্মদ। তিনি জানান, মরদেহ দুটি হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে এবং স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মরদেহগুলো হিমাগারে থাকবে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, কাউছার আলী পরিচয় দিয়ে যে ব্যক্তি আতিয়া মহলে বাসা ভাড়া নিয়েছিল সে-ই জঙ্গি মুসা। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় সে যে ছবি ব্যবহার করেছিল তার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মুসার যে ছবি রয়েছে, তার অনেকটা মিল রয়েছে। তবে মরদেহ দেখে পরিচয় শনাক্ত করার মতো অবস্থা নেই বলে এ মুহূর্তে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য ডিএনএর নমুনা ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়েছে।
আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার পুরুষের মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন মোগলাবাজার থানার এসআই সোহেল রানা। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, লাশের উচ্চতা আনুমানিক পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। মুখমণ্ডল গোলাকার, আগুনে পোড়া। কান দুটি স্বাভাবিক আছে। মাথায় সামান্য চুল আছে। ডান চোখ খোলা, মুখে অল্প দাড়ি আছে। দুই হাত শরীরের সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় লাগানো। লাশের বুক থেকে তল পেট পর্যন্ত পুরোটা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় রযেছে। গায়ে কালো একটি জামা ছিল। দুই পায়ে কালো জুতা রয়েছে। ডান পায়ে কালো প্যান্টের অংশ আছে। সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা সোমবার ৫টা ৫৫ মিনিটে আতিয়া মহলের নিচতলা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। গ্রেপ্তার এড়াতে সে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নারী জঙ্গির মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন মোগলাবাজার থানার এসআই সুচন দত্ত। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, তার উচ্চতা আনুমানিক চার ফুট। মাথায় অল্প চুল, মুখ পুড়ে গেছে। ওপরের পাটির দাত দেখা যাচ্ছিল। দুই হাত ও দুই পায়ের গিরা পর্যন্ত সম্পূর্ণ দেহ পুড়ে গেছে। এক পায়ে সামান্য মাংস আছে এবং পায়ের তালুর নিচে দুই ইঞ্চির মতো কাটা। গ্রেপ্তার এড়াতে সে গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শনাক্ত করতে আসছে পরিবার : নিহত নারী জঙ্গির আসলন নাম আদৌ মর্জিনা বেগম কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পুলিশের হাতে নিহত জঙ্গি জুবাইরা ইয়াসমিনের বোন মনজিয়ারা পারভিন ওরফে মোনজি আরা বেগমই হচ্ছে আতিয়া মহলের মর্জিনা বেগম। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গতকাল সকালে সিলেট পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বান্দরবান জেলা পুলিশকে বার্তা পাঠানো হয়। পরে বান্দরবান জেলা পুলিশ মনজিয়ারা পারভিনের পরিবারের দুই সদস্যকে সিলেট পুলিশের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়।
বান্দরবানের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বান্দরবানের বাইশারি তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ মুসা জানান, গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি থেকে পুলিশি পাহারায় মনজিয়ারার বাবা নুরুল আলম ও বড় ভাই জেয়াবুল হক সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
বিস্ফোরক শনাক্তে ড্রোন : সোমবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল আতিয়া মহলে প্রচুর বিস্ফোরক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় গতকাল সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ড্রোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ওই ভবনে বিস্ফোরক শনাক্তের কাজ শুরু করে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা জানান, সকালেই সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা ভবনটির ভেতরে ঢুকে বিস্ফোরক শনাক্ত করে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করার কাজ শুরু করেন। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী ভবনটি পুলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, শিববাড়ী এলাকার পাঁচতলা বাড়িটি গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটা থেকে ঘিরে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুক্রবার ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট সিলেটে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই দিন সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরাও ঘটনাস্থলে যান। শনিবার সকাল সেখানে কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ অভিযান শুরু করে। ওই দিন তারা বাড়ির ভেতরে আটকে পড়া ৭৮ জনকে উদ্ধার করে আনে। অভিযানের বিষয়ে শনিবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিং করার পরপরই ঘটনাস্থলের কাছে পাঠানপাড়ায় দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।