মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। মাঝে কয়েকদিন রোহিঙ্গা স্রোত কমলেও গত দু’দিনে হঠাৎ করেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ বেড়েছে। নতুন করে রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলে শুক্রবার থেকে তল্লাশির নামে রোহিঙ্গা নির্যাতন শুরু হওয়ায় ওই সব অঞ্চলের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ শনিবার রাতেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। আবার কেউ কেউ সীমান্তে সুযোগের অপেক্ষা করছেন। টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এবং এখানকার নোম্যান্স ল্যান্ডেও অবস্থান নিয়েছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক নানা চাপ ও নিন্দা উপেক্ষা করে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া বা তাদের নির্যাতন বন্ধ করার পরিবর্তে নতুন এলাকায় নির্যাতন শুরু করেছে। সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে শনিবার ও রোববার রাতে ২২টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার জন্য নতুন করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে জড়ো হয়েছে। রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলের আশপাশের গ্রামগুলো এতদিন সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বাইরে ছিল। কিন্তু নতুন করে সেখানে তল্লাশির নামে অভিযান শুরু করায় ওই অঞ্চলের লাখ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে আতঙ্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আকিয়াবের আশপাশের এলাকার গ্রামগুলোর রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের দিকে আসা শুরু করেছেন। সর্বশেষ আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এবং ওপারের কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে সোর্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহেদ হোসেন সিদ্দিক সোমবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘মাঝে কয়েক দিন রোহিঙ্গা আসা কিছুটা কমলেও দু’দিন ধরে আবারও প্রবেশের হার বেড়েছে। এ দু’দিনে ২০-৩০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে টেকনাফের সাবরাং সীমান্ত দিয়ে এসব রোহিঙ্গা আসছে এবং তারা মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে আসছে বলে খবর পাচ্ছি।’
জাহেদ হোসেন সিদ্দিক আরও বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আনতে সাবরাং সীমান্তে কাল (আজ) দুটি ট্রাক পাঠানো হবে। তাদের বালুখালী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হবে, যাতে তারা অন্যত্র ছড়িয়ে যেতে না পারে।’
এর আগে রাখাইন রাজ্যের মংডু, রাচিদং, বুচিদংসহ বিভিন্ন গ্রামে ২৫ আগস্ট সেনা অভিযানের নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের ২১৪টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে তাই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ দলে দলে ২২টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। শেষের দিকে এসে রোহিঙ্গা ঢল কিছুটা কমলেও এক মাস না যেতেই আবারও নতুন এলাকা আক্রান্ত হওয়ায় সীমান্তে বাংলাদেশমুখীদের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়েছে।
ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে সাড়ে চার লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। যাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ১০টি নতুন-পুরনো ক্যাম্পে। সেনাবাহিনী এরই মধ্যে তাদের জন্য ১৪ হাজার শেড নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যেখানে ঠাঁই পাবে ৮৪ হাজার পরিবার। খাদ্যাভাব সরকারি ও বেসরকারিভাবে পূরণ করতে প্রতিদিনই তাদের জন্য দেয়া হচ্ছে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী। ত্রাণের সুষম বণ্টনের জন্যও সরকার সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে। রোববার থেকে ত্রাণ বিতরণ ও শেড নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনও শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার প্রস্তুতি যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখনই আবার মিয়ানমারে নতুন এলাকায় সেনাবাহিনীর হামলা, তল্লাশির নামে নির্যাতন শুরু হয়েছে। এর জের ধরে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল নামতে শুরু করায় বাংলাদেশে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
মংডু থেকে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দিল মোহাম্মদ। তিনি জানান, মিয়নামার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা নতুন করে রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলে হামলা শুরু করেছে। বুধবার সন্ধ্যার দিকে আকিয়াবের ইত্তিপাড়ার একটি নির্জন এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ওই বোমা বিস্ফোরণ রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঘটিয়েছে এমন অভিযোগ তুলে শুক্র ও শনিবার আকিয়াব এবং ছিটুয়ে এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর তল্লাশির নামে নির্যাতন শুরু করেছে সেনাবাহিনী। এ অঞ্চলের হাজার হাজার নারী-পুরুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছেন। শনিবার ও রোববার রাতে বিভিন্ন সীমান্ত পার হয়ে নতুন করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
রাববার নতুন করে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ছোট একটি নদী পার হয়ে ৪-৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানান পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এমএ মঞ্জুর। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কয়েকজন জানান, ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কাঁটাতারের বেড়া আরও মজবুত করছে। চলাচলের পথে পুঁতছে মাইন। কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে দিচ্ছে বৈদ্যুতিক সংযোগ। রোহিঙ্গারা যাতে পালাতে না পারে এবং পালানোর সময় মারা পড়ে সে জন্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনী এমন মরণফাঁদ তৈরি করছে।
সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন এবং নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দু’দিনে ২২টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সদ্য অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের দাবি, উত্তর মংডু ছাড়াও আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলের রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে দলে দলে সীমান্তে এসে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
উখিয়ার থাইংখালী তাজমিরখোলা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ উল্লাহ (৩৪) জানান, তিনি রাখাইনের ছিটুয়ে থেকে পালিয়ে এসেছেন। মিয়নামার সেনারা সেখানে তল্লাশির নামে অভিযান শুরু করেছে। এতদিন তাদের কোথাও পালিয়ে না যেতে এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল সেনাবাহিনী। এখন তার মনে হচ্ছে, এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নিশ্চিহ্ন করার জন্যই। নতুন করে পালিয়ে আসা কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া রাচিদং এলাকার আনোয়ার হোসেন (৪০) জানান, রাচিদং এলাকার ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আকিয়াব ও ছিটুয়ে থেকে আসা আরও অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষা করছেন। প্রতি পরিবারের সদস্য কমপক্ষে ৭-৮ জন বলে জানান তিনি। বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া নুর মোহাম্মদ (৫৫) জানান, মংডুর ছৈঝাপাড়া, উকিলপাড়া, মংনিপাড়া, তামির ও বুচিদংয়ে আরও অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে যাতে পালিয়ে আসতে না পারেন। সেখানে অনেক রোহিঙ্গা মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে মারা যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। সোমবার অনুপ্রবেশ করে থাইংখালী স্কুল মাঠের অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া বুচিদং এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস (২৫) জানান, ৪ দিন ধরে দুর্গম পথ হেঁটে পরিবারের ১৭ সদস্য নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।
থাইংখালী তাজমিরখোলা ক্যাম্পের মাঝি জাফর আলম জানান, গত দু’দিনে নতুন করে ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন। সোমবার একদিনেই নতুন করে এসেছেন অন্তত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা।
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, রাখাইনে সহিংসতার এক মাস পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের আসা থামছে না। আগের মতো দলে দলে না এলেও প্রতি রাতেই নাফ নদী পেরিয়ে আসছেন শত শত রোহিঙ্গা। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আগের মতো স্রোতের মতো না এলেও দিন-রাতে প্রায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা এপারে আশ্রয় নিতে পালিয়ে আসছেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, রাখাইন এখনও অশান্ত ও উত্তপ্ত। তাই মৃত্যু ভয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।
সোমবার বিকালে প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গা টেকনাফ বাস স্টেশন এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যাওয়ার জন্য। সোমবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়া সীমান্ত দিয়ে তারা এ দেশে প্রবেশ করেছেন। এখানে কথা হয় রাখাইনের মংডু বদুছড়া এলাকার জালাল আহমদ ও বাগঘোনা এলাকার কাউছার পারভিনের সঙ্গে। জালাল আহমদ জানান, সোমবার ভোরে মা-বোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ ৬ জন মিস্ত্রিপাড়া সীমান্ত দিয়ে দালালদের মাধ্যমে এ পারে আসেন। ৩ দিন আগে সেনারা বদুছড়া গ্রামে অভিযান চালায়। বাড়িঘরে আগুন দেয়। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে এ দেশে আসতে হয়েছে। অবশ্য এর আগেই সেনারা গ্রামের বেশ কিছু লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তারপরও কিছু মানুষ এখনও গ্রামে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে বলে জানান জালাল। সীমান্ত পেরোতে জনপ্রতি মিয়ানমারের ৩০ হাজার কিয়াত দালালদের দিতে হয়েছে।
স্বামী-সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছে কাউছার : রাখাইনের বাগঘোনা এলাকার আবদুস ছালামের (৬০) স্ত্রী কাউছার পারভীন। সোমবার বিকালে এক সন্তানকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় বসে ছিলেন টেকনাফ বাস স্টেশন এলাকায়। মা, সন্তান উভয়ে ক্ষুধার্ত। এ সময় স্থানীয় লোকজন কিছু শুকনো খাবার রুটি, কলা, পানি খেতে দিলে গোগ্রাসে খেতে থাকেন। কাউছার জানান, সোমবার সকালে সীমান্ত পার হয়ে স্বামী ও দুই সন্তানসহ এ দেশে আসেন। সকালে শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ আসতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেন স্বামী ও ওমর ফারুক নামে আড়াই বছরের এক সন্তানকে। দিশেহারা কাউছার পারভীন অপর এক সন্তান সাদিয়াকে (১) নিয়ে কোথায় যাবেন জানেন না। তিনি আরও জানান, ১০-১২ দিন আগে সেনারা তাদের গ্রামে অভিযান চালিয়ে কয়েকশ’ বাড়িতে আগুন দেয়। ২০ জনের অধিক লোককে হত্যা করে।
এছাড়া রোববার দুপুরে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চর পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের মংডুর খুইন্যা পাড়া এলাকা থেকে আসে ১৮ রোহিঙ্গাবাহী একটি নৌকা। ওই নৌকার রোহিঙ্গা নারী ছলিমা খাতুন (৩৮) জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের গ্রামটি গত ৪ দিন আগে ছাই করে দিয়েছিল। গ্রামটি এখন জনমানব শূন্য, সেখানে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া গন্ধ। গ্রামের সবাই আগেই চলে এসেছেন, তারা সবশেষে এসেছেন। ওই গ্রামটি এখন রোহিঙ্গাশূন্য।
সূত্র- যুগান্তর
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।