সন্ত্রাসবাদ দমনে সৌদি জোটে যোগদানের পর থেকেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের অবসান ঘটতে শুরু করে। সম্প্রতি সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদানের পর এই সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এই সামিটে আরব ও বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অংশ নেন।
সেখানে সৌদি বাদশা ও ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময়ের মাধ্যমে এই দুটি দেশের কাছে আস্থা ও ইতিবাচক সম্পর্কের বার্তা পৌঁছেছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। যদিও সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে বর্তমান সরকার।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, রিয়াদে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে সৌদি বাদশা তার বিশেষ দূত, সাংস্কৃতিক ও তথ্যমন্ত্রী আওয়াদ বিন-সালেহ-আল-আওয়াদকে ঢাকায় পাঠান। তিনি ৯ মে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন। সৌদি সরকার চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত সে দেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এই আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করতে পারতেন। কিন্তু বিশেষ দূত পাঠানোয় বাংলাদেশকে যে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি সরকার তা বুঝিয়ে দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেন, এই সম্মেলনে যোগ দিতে সৌদি বাদশার এই আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই সফরের মধ্যে দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, রিয়াদে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিটে ৫৫টি মুসলিম দেশ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অংশ নেন। এ সময় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি হয়। এই সামিটে এসে ট্রাম্প বিশাল বাণিজ্য করার পাশাপাশি নিজের মুসলিম বিদ্বেষী ইমেজে কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করলেন।
অন্যদিকে সৌদি আরবও বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেখাতে পারলেন ৫৫টি মুসলিম দেশ তার সঙ্গে আছে। তাই বিশ্বের সন্ত্রাস দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি।
তবে এই সম্মেলনে দু’দেশের লাভ হলেও বাংলাদেশেরও উপকার হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে এমনিতেই বাংলাদেশের প্রশংসা রয়েছে। এখন নতুন করে এই দুটি বৃহৎ দেশের আস্থা অর্জন ও নেকনজরে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। আগামীতে বাংলাদেশ এর সুফল নিতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র জানায়, সৌদি আরবের উদ্যোগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গঠিত সন্ত্রাসবিরোধী জোটে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়া ছিল বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রথম ধাপ। এই সিদ্ধান্তের ফলে দীর্ঘ ৭ বছরের টানাপড়েন কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশের প্রতি সৌদি আরবের আস্থা ফিরে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের জোরালো সমর্থন আদায়ে গত বছর মার্চে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসেন।
এ সময় তিনি বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার ও নার্সসহ আরো দক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মী নিয়োগের আশ্বাস দেন। এরপর বাংলাদেশি স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের নিয়োগের লক্ষ্যে মেডিকেল ডিগ্রি ও অন্যান্য সুবিধাদি পরিদর্শনে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দল ঢাকায় আসে।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বিজনেস ভিসা ইস্যু করতে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন আল জুবেইর। সৌদি আরবে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার বিষয়েও একমত হন এবং উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সৌদি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সফর করেন।
এছাড়া জোটে যোগদানের এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশি ওমরা হজযাত্রীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেশটি। তবে সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোট গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আইএস, আল-কায়েদাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর উত্থানে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে চাপে ছিল দেশটি। এই চাপের কারণেই সৌদি সরকার এ ধরনের সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়। সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোটে প্রাথমিকভাবে ৩৪টি দেশ অংশ নেয়।
এছাড়া গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে দেশটি। প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের রিয়াদ থেকে মদিনা যাওয়ার জন্য সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ তার নিজস্ব লাক্সারি বিমান দেন। এছাড়া রাজকীয় আতিথিয়তা দেন সৌদি বাদশা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সৌদি সফরের মাধ্যমে সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।
শুধু তাই নয়, দু’দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ দমন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে পারস্পরিক সহযোগিতা আরো শক্তিশালী করার ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে প্রথমবার সম্মত হয় দেশটি। এর আগে কখনো সৌদি আরব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এত গুরুত্ব দেয়নি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।