অনিশ্চিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে প্রর্ত্যাবাসন চাইছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের আজকের দিনে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা সখিনা খাতুন ও আবদুল জব্বারসহ আরো অনেকে এই দাবি তুলেছেন এবং তাদের সুষ্ঠু প্রর্ত্যাবাসনের।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী হলেও দেশটির সরকার তাদের বৈধ নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করায় মুসলমান এই জনগোষ্ঠি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে। তবে ভাষা ও সংস্কৃতির মিল থাকায় এরা খুব সহজেই এসে পড়ছে বাংলাদেশে। আশ্রয় নিচ্ছে সীমান্ত শহর কক্সবাজার ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের আশপাশের এলাকায়। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে চলছে রোহিঙ্গাদের এদেশে আসার প্রক্রিয়া। মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে ২ লাখ ৫২ হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে চলে এসেছিল। পরবর্তীতে জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের মধ্যস্থতায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরনার্থী স্বদেশে ফিরে গেলেও মিয়ানমার সরকারের ছাড়পত্র না দেয়ার কারনে আরো ২৫ হাজার শরনাথী স্বদেশে ফেরত যায়নি।
স্বদেশে ফিরে গিয়েও আবারও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তারা। গত ৫ বছরে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫০ হাজারের মতো অবৈধভাবে অবস্থান করছে কুতুবপালং শরনার্থী শিবির সংলগ্ন ৪/৫ টি পাহাড়ে।
এছাড়া নয়াপাড়া ক্যা¤প সংলগ্ন লেদা গ্রামে ঝুপড়ি বাসা তৈরি অবস্থান করছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। এরা সবাই আনরেজিষ্ট্রার্ড শরনার্থী হিসাবে পরিচিত। এ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার কারণে উখিয়া ও টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজার জেলায় দেখা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সহ নানা সামাজিক অস্থিরতা।
ইউএনইচসসিআরের কক্সবাজারের অফিস সূত্র মতে, উখিয়া ও টেকনাফের দুটি শরনার্থী ক্যা¤েপ বর্তমানে প্রায় ২৯ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। ২টি ক্যা¤েপর সাথে লাগোয়া অন্য ২টি আন রেজিষ্ট্রার্ড ক্যা¤েপ রয়েছে ৮০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই ২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রর্ত্যাবাসন করা হয়েছিল। এরপর থেকেই প্রর্ত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
উখিয়া-টেকনাফের ২টি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যা¤েপর প্রায় ২৯ হাজার রোহিঙ্গা ছাড়া টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত ৩০ হাজার আর উখিয়া কুতুবপালং ক্যা¤েপর পাশ্ববর্তী ৫০ হাজার অনিবন্ধিত এবং কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা অবৈধ বসবাস করছে। রাখাইন প্রদেশে বার বার রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইনদের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা।
জেলা আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক মাসিক সভার সর্বশেষ তথ্য মতে, কক্সবাজারের শতকরা ৯৫ শতাংশ অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে এসব রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা সহ নানা নাশকতায় জড়িত রয়েছে। কক্সবাজারের আলোচিত ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা, এবছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের তান্ডবে ৩ জনের প্রাণহানির ঘটনায়ও এসব রোহিঙ্গা অংশ নেন।
সুত্রে জানা যায়, সীমান্তে এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর ফাকি দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে থাকে। আইনশৃঙ্কলা বাহিনী সদস্যরা তৎপর থাকায় দিনের বেলা কিছুটা রোধ করা হলেও রাতের আধাঁরে রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্তে বাংলাদেশে ডুকছে।
জেলায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে ভোটার তালিকাভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা চুরি-ডাকাতি, মানব ও ইয়াবা পাচারের জড়িত রয়েছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তাদের জন্য নেই সেখানে কোন কাজ। তার ফলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা কম টাকায় যে কোন কাজ করতে রাজি। তারা বাংলাদেশে ডুকে যে কোন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চলতি বছরের মে থেকে জুন মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকালে নারী, শিশু ও পুরুষসহ ৪ শ’ রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড। পরে আটককৃতদের স্ব স্ব সীমান্ত দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার নাইট্যংপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, জাদিমুরা হ্নীলা, সাবরাং, হোয়াইক্যংসহ ১০-১২টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়িত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে উপজেলার বিভিন্ন লোকজনের ভাড়া বাড়িতে আত্মগোপন করেছেন।
টেকনাফ সাংবাদিক ইউনিটির যুগ্ন সাধারন সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন ভুলু জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা কোন দিন সমাধান হবেনা। নাফনদী সীমান্ত অরক্ষিত রয়ছে। যত দিন সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া না হবে ততদিন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবেনা । তিনি আরো জানান, জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রভাবশালীর সহযোগীতায় ভোটার তালিকাভুক্ত হয়ে হয়েছিল। চুরি-ডাকাতি, ইয়াবা ও মানব পাচারের সাথে জড়িত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। উপজেলায় বিভিন্ন পাহাড় দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। এই সব পাহাড়ে প্রায় ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের উচ্ছেদের কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
রোহিঙ্গাদের বিশাল নারী এবং কিশোরী গোষ্ঠি যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়েছে। আবার বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্ঠি করেছে এরা। এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের শরণার্থীদের দ্রুত স্বদেশ ফেরতের দাবি উঠেছে। আর রোহিঙ্গারাও সম্মানজনক স্বদেশ ফেরতের পক্ষে রয়েছেন।
স্থানীয় ইউএনএইচসিআরের সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ এবং শরণার্থীদের ছাড়পত্র না দেয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম করা যাচ্ছেনা।
গত বছর মিয়নমারের ইয়াংগুনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মিয়নমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সচিব পর্যায়ে আন্তঃদেশীয় দ্বি-পাক্ষিক সম্মেলন এ অংশ নিয়ে দেশে আসার পর রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রর্ত্যাবাসন কমিশনার ফিরোজ সালাহ উদ্দিন বলেন, সম্মেলনে রেল যোগাযোগসহ আটটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রর্ত্যাবাসন এর বিষয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কারন মিয়নমার এখন তাদের অভ্যন্তরিন দাঙ্গায় বসতভিটা হারানোদের পুনর্বাসন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। তাদের এ সমস্যা শেষ হলে আমাদের দেশে থাকা শরনার্থীদের দিকে নজর দেবেন তারা।
পুলিশে একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার জেলায় আইন শৃঙ্খলা অবনতির জন্য রোহিঙ্গাদের ভুমিকা সবচেয়ে বেশি। এরা নানা স্থানে ডাকাতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে।
টেকনাফ ৪২ বিজিবির ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, সীমান্তে রোহিঙ্গা ঠেকাতে বিজিবি সমসময় তৎপর রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে গত মে মাসে সাড়ে দুই শতাধিকের অধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে স্বদেশে ফেরত দিতে সক্ষম হয়েছে বিজিবি। তবে আগের তুলনায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের অনেকটা কমছে বলে দাবি করেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।