উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে। একের পর এক ঘটনায় শঙ্কা বাড়ছে ক্যাম্পে থাকা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝেও। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় প্রশাসন। সর্বশেষ রোববার রাতে বন্দুকযুদ্ধে একই দিনে ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে নতুন করে। আইন শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ক্যাম্পে বেশ কিছু গ্রুপ নানা ধরণের সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এদের বিরুদ্ধে এখনই শক্ত ব্যবস্থা না নিলে সামনে বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ড বাড়ায় স্থানীয় নাগরিকরাও শঙ্কিত। সম্প্রতি প্রায়ই অপরাধীদের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধের’ ঘটনা ঘটছে।
এতে অপরাধীদের মৃত্যু হচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলেও মূল গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না বলে তারা মনে করছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ১২৭৩ জন রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি আছে। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৭৩ জন।
উখিয়ার ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বাস করছেন নিবন্ধীত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯১৩ জন রোহিঙ্গা। এরই মাঝে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে কিছু গ্রুপ। সরজমিন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিকাল ৫টার পর ঢুকতে পারেননা বাইরের কেউ। ৫টার পরেই পরিবর্তন হয়ে যায় ক্যাম্প এলাকার চেহারা। ক্যাম্পের সড়কে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ায় থাকলেও অনিরাপদ হয়ে ওঠে ভিতরের চিত্র। দিনের বেলা এসব গ্রুপের সদস্যদের সাদামাটা জীবন। আর রাত হলেই মুদ্রার উল্টো পিঠ। ক্যাম্প এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এসব গ্রুপের সদস্যরা। অন্যান্য গ্রুপের সক্রিয়তা থাকলেও আলইয়াকিন গ্রুপ সবথেকে শক্তিশালী অবস্থানে আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কুতুপালং ও বালুখালী দুই ক্যাম্প এলাকার নিয়ন্ত্রিত হয় নৌকার মাঠ নামক স্থান থেকে। দিনের বেলা এই মাঠ থাকে স্বাভাবিক। জানা যায়, ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে দেশীয় অস্ত্র হাতে ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য পাহাড়া দেয়। ক্যাম্পে স্বচ্ছল রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, ইয়াবার চালান, দেশের বিভিন্ন এলাকা ও সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তারা। গৃহপালিত পশু, ফসল, ফলসহ স্থানীয়দের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুরি ডাকাতির সঙ্গে জড়িত এই গ্রুপ। সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, পুরো ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে আলইয়াকিনের ৩ জন নেতা। তাদের দায়িত্ব পরিবর্তন হয় ৩ মাস পরপর।
ক্যাম্পে ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রায় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত খুন হয় অন্তত ৩৩ জন।
ক্যাম্পের প্রতি ব্লকের সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতাদের বলা হয় ‘মাঝি’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাঝি বলেন, আমরা এখানে সকল ধরণের মানবিক সেবা পেলেও ভয়াবহ বিপদের মুখে আছি। আলইয়াকিনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পর্যন্ত জানাতে পারি না আমরা। প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই ভয়ে মুখ বন্ধ রাখতে হয়।
স্থানীয় একজন এনজিও কর্মী বলেন, আমি তখন সদ্য কাজ শুরু করেছি। এক ব্লকে রাতে একটি খুন হয়। রোহিঙ্গা সহকর্মীর কাছে জনসম্মুখে জানতে চাই কিভাবে খুন হয়েছে? সে আমাকে বলে, চুপ এই বিষয়ে একটা কথাও না। বিপদে পড়বা। তিনি আরো বলেন, আমি প্রায় ৬ মাস ধরে খেয়াল করছি, ক্যাম্পে যখন কিছু ঘটে তার আগে সেই এলাকার স্ট্রিট লাইট ভেঙ্গে ফেলা হয়। এছাড়াও নৌকার মাঠ এলাকায় প্রায়শই থাকে না লাইট।
২, ৩, ৪, ৫, ১৭ ও ১৯ নম্বর ক্যাম্প এলাকার কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই বিরোধীতা করে তারা। যারা প্রত্যাবাসনের সম্মতি জানাতে ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে যান তাদেরকেই অস্ত্রের মুখে হুমকি দেয়া হয়। ৪ নম্বর ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গা বলেন, আমি নোয়াখালীর ভাষাণচরে যাবার ইচ্ছাপোষণ করেছিলাম। ক্যাম্প ইনচার্জকে জানানোর আগেই রাতে ৬ জন আলইয়াকিনের সদস্য প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র এক জরিপে দেখা যায়, স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু। তাদের সংখ্যা মাত্র ৩৪ শতাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, আমি কয়েকবার অভিযোগ জানিয়েও কোন লাভ পাইনি। একবার অভিযোগ জানানোর পরে ফোন করে (০১৮৬৫৯৮৫৯১২) হুমকি দেয়া হয়। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাই কোন লাভ হয়নি। এরপর একদিন ক্যাম্প এলাকায় অস্ত্রসহ হুমকি দেয়া হয়। এরপর থেকেই আমি চুপ।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আসা একজন রোহিঙ্গা বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করবার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই ছিল মিয়ানমারের। বারবার হত্যাযজ্ঞসহ নানা নির্যাতন চালালেও সফল হয়নি তারা। কিন্তু ২০১৭ সালে এসব গ্রুপ পুলিশ চৌকিতে হামলা চালায়। আর তাদের নিয়ন্ত্রণে হত্যাযজ্ঞ চালায় মিয়ানমার আর্মি ও ভান্তেরা। আসলে এসব গ্রুপ মিয়ানমারেরই প্রশাসনের সৃষ্টি। তারা এখনও নানা অপকর্মের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন বিরোধী কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, সদস্যরা অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত। তাদের ধর্মের কথা ও অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এই ক্যাম্পে এত মসজিদ। নামাজের সময় দেখবেন তরুণরা নাই।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের ঊর্ধতন এক কর্মকর্তা স্বীকার করেন সন্ত্রাসী গ্রুপের কথা। তিনি বলেন, তারা জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, রাতের বেলা অস্ত্র মহড়া ইত্যাদি দিয়ে থাকে। আমরা কোন অপরাধ হলে সেখানে যাই। গ্রেপ্তার করি।
ক্যাম্পে দায়িত্বরত বিজিবি’র একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এইরকম গ্রুপের কথা শুনেছি। কোন ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে যাই। কিছু দিন আগে খবর পেয়েছিলাম গ্রুপের সদস্যরা অস্ত্রসহ মহড়া দিচ্ছে। সাধারণ একজন রোহিঙ্গা খবর দিয়েছিলেন। আমরা যাওয়ার আগেই খবর পেয়ে পালিয়ে যায় তারা।
উখিয়া থানার পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল মনসুর বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে সচেতন আছি। আমাদের লোকেরা সার্বক্ষণিক তৎপর আছে। যেকোন ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাহমুদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, এই রকম গ্রুপের কথা আগে থেকেই শুনে আসছি। ক্যাম্পে ১০ লাখ লোক বেকার। আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডা। এই কারণেই এসব গ্রুপ তৈরি হয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অনেক সময় খবর পাই তারা সংগঠিত হচ্ছে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তিনি বলেন, আলইয়াকিন গ্রুপের কথা আমরাও শুনেছি।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, এরকম কয়েকটা গ্রুপের অবস্থান আছে। আর আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর আছে বলেই তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও জনবল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে নতুন ৭টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। চলছে জয়েন্ট পেট্রোলিং, মোবাইল কোর্টসহ নানা কার্যক্রম। ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা আছেন তারা যেকোন ধরণের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ক্যাম্পে এই ধরণের যারা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত তাদের অতি দ্রুত তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তার করা উচিত। ক্যাম্প এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে এই অপরাধ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
সূত্র. মানবজমিন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।