গিভ ব্লাড গিভ লাইফ অর্থাৎ রক্ত দিন জীবন বাঁচান- এটাই হচ্ছে বাংলাদেশে এবারের বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য।আজ বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতিবছর ৮ মে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। এ রোগ বাবা-মায়ের কাছ থেকে সন্তানের মাঝে আসে।বেশিরভাগ রোগী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। প্রতি ২ সপ্তাহ পরপর তাদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে কিছুই দরকার হয় না। আরেক দল আছেন, এ দুইয়ের মাঝামাঝি। তাদের মাঝে মাঝে রক্ত দিতে হয়।
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি থ্যালাসেমিয়ার ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ এবং ‘স্টেম সেল থেরাপি’র ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনও করা সম্ভব হয়নি। অস্থায়ীভাবে সারাজীবন অন্যের রক্ত নিয়ে গুরুতরভাবে আক্রান্ত এই রোগীদের বেঁচে থাকতে হয়।
মাসে এক বা একাধিকবার রক্ত নিতে হয়। এজন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু জীবনভর প্রতি মাসে এই ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অধিকাংশ রোগী ও তার পরিবারের থাকে না। ফলে একটা পর্যায়ে তারা চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় এবং তাদের একটা অংশ মারা যায়।
চিকিৎসকদের মতে, জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এ রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বা আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশে এখনো হয়নি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, থ্যালাসেমিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় ১০-১২ ভাগ মানুষ আক্রান্ত। এ হিসাবে বর্তমানে দেশের প্রায় দেড় কোটি লোক এ রোগের বাহক। প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু এই রোগে ভুগছে এবং প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাত হাজারেরও বেশিসংখ্যক শিশু এই ঘাতক ব্যাধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সারাবিশ্বে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ লোক থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও হাসপাতালের হিসাবে, প্রতিবছর ১০-১২ হাজার শিশু এই থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ল্যাবওয়ান ফাউন্ডেশন অব থ্যালাসেমিয়ার সভাপতি ডা. মো. সালাহউদ্দীন শাহ্ এর মতে, ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। এই রোগে আক্রান্তরা সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। বাবা অথবা মা কিংবা মা-বাবা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। তবে এটি ছোঁয়াচে রোগ নয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীর শরীরে যে লাল রক্ত কণিকা তৈরি হয়, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভেঙে যায়। আর এই সেল ভাঙার কারণে শরীরে একদিকে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, অন্যদিকে বিলিরুবিনের এবং আয়রনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীর হলদেটে হয়ে যায়।
এ ছাড়া অতিরিক্ত আয়রনের কারণে শরীরের বর্ণ হয়ে যায় তামাটে বা ধূসর। এ কারণে তাদের নিয়মিত রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। অনেক সময় দুয়েক বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে এটি তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ডা. মো. সালাহউদ্দীন শাহ জানান, বিয়ের আগে বর ও কনের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। রক্ত পরীক্ষায় যদি দুজনেই বাহক বা একজন বাহক অন্যজন রোগী হয় তাহলে তাদের সন্তান-সন্ততিও এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাই তাদের বিয়ে না করাই উত্তম।
ডা. মো. সালাউদ্দীন শাহ জানান, ল্যাবওয়ান ফাউন্ডেশন অব থ্যালাসেমিয়া আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য সরকারের সহায়তায় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া বেসরকারিভাবেও সব সংগঠনকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষকে উত্সাহিত করতে হবে, জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আলাদা চিকিত্সার ব্যবস্থা করা, ওয়ানস্টপ হাসপাতাল নির্মাণ, তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা, গবেষণা সেন্টার ও রেফারেল ল্যাব স্থাপন করতে হবে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ বারডেমে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ইতোমধ্যে এই দিবসটিকে সামনে রেখে ল্যাবওয়ান ফাউন্ডেশন অব থ্যালাসেমিয়া শোভাযাত্রা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।