রবীন্দ্রনাথ তার ‘খেলা’ কবিতায় শিশুর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি/জগৎ-মাতা রয়েছে জাগি’। বিশ্বে শিশুর জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রথম উপহার হলো মা ও বাবা। শিশুর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলকামী হলেন মা। কুসন্তানের দৃষ্টান্ত থাকলেও কুমাতা কখনো দেখা যায় না। আজ বিশ্ব মা দিবস। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন। আমাদের দেশে মা দিবসের প্রচলন গত কয়েক বছরে। যদিও আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশ্ত’, ‘জননী স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী’ বলা হয়েছে যুগ-যুগ ধরে।
আধুনিক মা দিবসের প্রচলন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন সমাজসেবক আনা জার্ভিস ১৯০৫ সাল থেকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিবস হিসেবে ‘মা দিবস’ প্রচলন করার পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। ১৯০৮ সালে আনা জার্ভিস ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে তার মৃত মায়ের স্মরণে চার্চে একটি স্মৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৯১২ সালে তিনি মাদারস ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস প্রচলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন জার্ভিস। প্রথমদিকে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় স্থানীয়ভাবে মা দিবসে স্বতঃস্ফূর্ত ছুটি পালিত হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এ দিনটিকে সাধারণ ছুটির দিন করার প্রস্তাব প্রথমে উড়িয়ে দিলেও পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের সুপারিশে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯১৪ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সব মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন হিসেবে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস করার পক্ষে সুপারিশ করেন। পরে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং অন্য প্রেসিডেন্টদের সমর্থনে দিনটি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে পালিত হতে থাকে।
মা দিবস পালনের ঐতিহ্য অবশ্য ইউরোপে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে মাতৃদেবী সিবিলির পূজার দিনটিকে মাতৃ দিবস হিসেবে পালনের রীতি ছিল। সিবিলি ছিলেন রোমান পুরাণ অনুযায়ী মাতৃদেবী। তিনি প্রকৃতির প্রতিপালিকা। এজন্য পরে তিনি তিন প্রধান মাতৃদেবীর অন্তর্ভুক্ত হন। তিনজন দেবী রোমে মাতৃদেবী হিসেবে পূজিত হতেন। এরা হলেন সিরিস, সিবিলি ও ভেনাস। রোম, গ্রিস ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এপ্রিল, মে, জুন মাসের বিভিন্ন দিনে মা দিবস পালিত হতো। মাতৃ দিবসের সম্মানে তখন মাকে উপহার দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। খ্রিস্টধর্মের প্রসারের পর মা মেরীর সম্মানে মা দিবস পালিত হতে থাকে। সাধারণত লেন্ট পরবের চতুর্থ রোববার মা দিবস পালিত হতে থাকে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মা দিবস পালিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে হযরত মুহম্মদের (স) কন্যা বিবি ফাতেমার সম্মানে মা দিবস পালনের রীতি রয়েছে। চীন, জাপানসহ দূরপ্রাচ্যে দিবসটি উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায়ও মা দিবস পালিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। নেপালে মা দিবস পালনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণ ও তার মা দেবকীর একটি পৌরাণিক কাহিনি।
ভারতে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার দিবসটি পালিত হয়। তবে এর সঙ্গে ধর্মীয় কোনো আচারের সম্পর্ক নেই। সেখানে দিবসটি শহুরে সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত। বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত দিনটি মূলত শহরাঞ্চলের পরিবারগুলোতেই সীমাবব্ধ। বাংলাদেশে মা দিবস পালনের অংশ হিসেবে মাকে উপহার প্রদান, মায়ের জন্য বিশেষ খাবারের আয়োজন, মায়ের সঙ্গে বেড়ানো ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। যদিও বছরের প্রতিটি দিনই মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা প্রয়োজন। তবে এ ধরনের দিবসগুলোর ফলে সমাজে নতুনভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং প্রবীণ মা-বাবার যতœ, তাদের অধিকারের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতনতার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবাকে প্রেরণ না করার বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে মা দিবস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।