বিশেষ প্রতিবেদক::জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন বাড়াতে মা ইলিশ রক্ষা ও স্বচ্ছন্দে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দিতে ১ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে সাগরে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। টানা ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞায় সারা দেশে ইলিশ পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ বা বিক্রয়ও বন্ধ করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় সাগরের মাছ শিকারের নৌযান চলাচলের কোলাহল। সেই নিষেধাজ্ঞার সময় পার করে ২৩ অক্টোবর থেকে ফের প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরেছে জেলেপাড়া ও ফিশারীঘাটে। সাগর পানে ছুটছে ইলিশসহ সব ধরণের মাছ শিকারীরা।
নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা রোধে ১৪টি ভ্রাম্যমান আদালত চালিয়ে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মিটার বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ জাল জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে। এ ছাড়াও ৭ জেলেকে আটক করে ২১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
কক্সবাজার জেলা বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহামদ জানান, সোমবার ও মঙ্গলবার (২৩-২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েকশ ফিশিং বোট মাছ ধরতে সাগরে রওয়ানা হয়েছে। বাকি বোটগুলোও তৈরী হচ্ছে মাছ ধরা উৎসবে যোগ দিতে। আগামী ৪-৫দিনে সব বোট সাগরে যেতে পৌছে যাবে বলে ধারণা করছি।
তিনি আরো জানান, কক্সবাজার নাজিরারটেক, কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতিপাড়া, কস্তুুরাঘাটসহ জেলার অন্যান বেশকটি ঘাটে শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার সাগরে যেতে প্রন্তুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বহদ্দাররা জানিয়েছেন। স্ব-কর্মে ফিরতে পারায় জেলে পাড়ায় এবং মৎস্যঘাটে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
এদিকে এ বছর ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গত ১ অক্টোবর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের মতো ইলিশ ধরা হয়েছে। কিন্তু বাকি সময়ে আহরণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে না।
তাদের আনুমানিক হিসাব হচ্ছে, এ বছর এখন পর্যন্ত আনুমানিক ২ থেকে আড়াই লাখ ইলিশ ধরা পড়েছে। বরিশাল, পাথরঘাটা, ভোলা, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও শরীয়তপুরের জেলেদের তথ্য মতে, এ বছর এখনও দেশের নদীতে কাঙ্খিত পরিমাণ ইলিশের দেখা মেলেনি। বাজারে যা উঠেছে, তার ৯০ শতাংশই সাগরের ইলিশ। সাগর মোহনায় আরও ইলিশ আছে।
গভীর সাগরে এখনও প্রচুর ইলিশ রয়েছে। এ সব ইলিশই মাঝ নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। ইলিশের খনি বলে খ্যাত ভোলার তেঁতুলিয়া, পটুয়াখালীর পায়রা, পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা এবং চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এ বছর ইলিশ মাছ ধরা পড়েনি। সাগরের ইলিশই এ বছর উঠেছে বাজারে।
সূত্রে জানা গেছে, জেলেদের জন্য গত ২১ দিন ইলিশ ধরা বন্ধের সময়ে বাংলাদেশের সাগর সীমায় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা বেপরোয়াভাবে ইলিশ শিকার করেছে। ভারতীয় জেলেরা মা ইলিশসহ সকল প্রকার মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাদের মাছ ধরা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হওয়ায় এমনটি হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ভারতীয় জেলেদের আগ্রাসনের বিষয়টি নিয়ে এর আগেও জেলার মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক ও শ্রমিকরা একাধিকবার মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা ড. মঈন উদ্দীন আহমেদ জানান, এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত পরিমাণ ইলিশ ধরা না পড়লেও সময় শেষ হয়ে যায়নি। অবশ্যই নদীতে ইলিশ আছে। জেলেদের জালেও ধরা পড়বে। আমরা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ইলিশ পাব বলে আশা করছি।
তিনি আরো বলেন, গত বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগের তিন দিন ও পরের এগারো দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। আর এ বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগে চার দিন ও পরের সতের দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পার হওয়ার পরও মা ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এ জন্যই এ বছর সময় ৭দিন বাড়িয়ে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এর সুফল পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেনি তিনি।
তার মতে, জেলার আপামর জেলে সম্প্রদায়, ফিশিংবোট মালিক, বরফকল মালিক, জ্বালানী তৈল সরবরাহকারী, মৎস্য আড়তদার, মৎস্য বিক্রেতা ও বিভিন্ন বাজার কমিটির সদস্যগন সরকারগৃহীত কর্মসূচী বাস্তবায়নে সহযোগীতা করেছেন। উপরোক্ত ২২ দিনব্যাপী মৎস্য আহরণে বিরত থাকা দরিদ্র জেলেদের জন্য বিশেষ ভিজিএফ কর্মসূচীর মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা হিসাবে জেলার ৮ উপজেলায় ১০ হাজার ৫০০ জন নিবন্ধিত জেলে পরিবারের জন্য ২১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়।
কক্সবাজারে প্রধান প্রজনন মৌসূমে মা ইলিশ রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের সাথে সমন্বয় করে উপরোক্ত কর্মসূচী পালিত হয়। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, উপরোক্ত ২২ দিনে জেলার ৮ উপজেলায় মোট ১৪ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযান চালানো হয়েছে ২৭০ টি। ২৫২ বার অবতরনকেন্দ্র, ৪৫৩ বার মাছঘাট পরিদর্শন, ৫৩২ বার আড়ৎ ও ৮৯৪ বার বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে। এসময় প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মিটার বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৬৩ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও ৭ জেলেকে আটক করে ২১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, সোমবার দিবাগত রাত বারটায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর ফিশিং বোটগুলো সাগরে গেছে, এখন রূপালী ইলিশের জন্য অপেক্ষা করছেন সংশ্লিষ্ট বোট মালিক ও শ্রমিক পরিবার।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।