স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত দুই ইয়াবা পাচারকারী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের নেতৃত্বে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে পাচারকারীরা শোডাউন করেছে। এ শোডাউনের উপলক্ষ ওই উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে দুজনের মনোনীত হওয়া।
এ দুই নেতার মধ্যে ইয়াবার চালান নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়া আসামি সভাপতি হয়েছেন। আর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারীর ছেলে ও হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। তিনি ইয়াবা পাচারে জড়িত বলেও এ মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ১০ নভেম্বর টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সম্মেলন হয় হ্নীলা বাসস্টেশন চত্বরে। ওই সম্মেলনে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম যথাক্রমে প্রধান বক্তা ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, সম্মেলনের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কৌশলে কাউন্সিল করার কথা বলে দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান নিয়ে যান টেকনাফ সদরে। সেখানেই কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করার কথা বলা হয়। কিন্তু গত শনিবার রাতে বিতর্কিত দুজনকে নিয়ে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
জানা গেছে, নতুন এই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে যথাক্রমে সাইফুল করিম ও নুরুল আমিন ফাহিমকে। তাঁদের মধ্যে সাইফুল একাধিক অস্ত্র, ছিনতাই, হত্যাচেষ্টা, ছাত্রী অপহরণ ও ইয়াবা পাচার মামলার আসামি। গত বছরের ৩ জানুয়ারি কক্সবাজার সদর থানার লিংক রোডে তিশা বাস কাউন্টারের সামনে থেকে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অভিযানে ইয়াবাসহ ধরা পড়েন তিনি। তাঁর কাছ থেকে ৭০০টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই সাইফুলকে ইয়াবাসহ কক্সবাজার সদর থানায় সোপর্দ করা হয়। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। এ ঘটনায় করা মামলায় সাত মাস কারাগারে থাকার পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। এখনো তিনি ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের বিদায়ী সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন সোহেল কালের কণ্ঠকে বলেন, “টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন হচ্ছে নাফ নদের তীরবর্তী ইয়াবা পাচারের একটি স্বর্গ। তাই হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ‘ইয়াবা পরিবারের’ সন্তানদেরই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।”
অন্যদিকে মনোনীত সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন ফাহিম ২০১৪ সালে টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারী নূর মোহাম্মদের ছেলে।
তিনি নিজেও একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের আমলি আদালতে দাখিল করা ৫৮৬ নম্বর অভিযোগপত্র সূত্রে জানা গেছে, ফাহিমদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি র্যাব-৭-এর (কক্সবাজার) উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মোহাম্মদ আলী হায়দারের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল এই অভিযান চালায়। ওই অভিযানে পাওয়া ইয়াবাসহ তাঁর মা মিনারা বেগমকে আটক করে নিয়ে যায়। এরই সূত্র ধরে ফাহিমের নেতৃত্বে ইয়াবা পাচারকারী র্যাবের সোর্স সন্দেহে প্রতিবেশী স্কুল ছাত্র সরোয়ারুল ইসলামকে অপহরণের পর হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনায় নিহত এই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মা ছকিনা বেগম বাদী হয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা করেন।
এ মামলার অভিযোগপত্রে ফাহিমকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে উল্লেখ করেছে পুলিশ। এ ছাড়া তাঁকে পলাতক আসামি হিসেবে দেখানো হয়।
ইয়াবা ও হত্যা মামলার আসামিদের ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক মনোনীত করার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় টেকনাফ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর ইসলামের কাছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয় আমি জানি না।’
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয় বলেন, ‘বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মনোনীত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই ইয়াবা পাচারকারী পরিবারের সন্তান।’
হ্নীলা ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির মনোনীত সভাপতি সাইফুল করিম তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলা থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব মামলার বেশির ভাগই ষড়যন্ত্রমূলক।’
হ্নীলা এলাকাবাসী জানায়, সাইফুল ও ফাহিম ছাত্রলীগের নেতা মনোনীত হওয়ায় এলাকায় শোডাউন করেছে ইয়াবা পাচারকারীরা। শতাধিক গাড়ি নিয়ে করা এই শোডাউনের নেতৃত্বে ছিলেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদা। তাঁরই আপন ভাতিজা হচ্ছেন ফাহিম। শোডাউনের নেতৃত্বে থাকা আরেকজন হলেন একই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামশুল আলম। তিনিও তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারী।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জানান, শোডাউনে অংশ নেওয়া লোকজনের বেশির ভাগই ইয়াবা পাচারকারী চক্রের সদস্য।
এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাঞ্চন কান্তি দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের শোডাউনের খবর তাঁর জানা নেই।
সূত্র:কালেরকন্ঠ
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।