এ এইচ সেলিম উল্লাহ:
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে আবারো বানের স্্েরাতে রোহিঙ্গা আসা শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে এ যাত্রা শুরু হয়। সেদিন একদিইে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষ সীমান্তের শুন্য রেখা পার হয়ে কুতুপালং-বালুখালী ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় মিশে যায়। এনিয়ে সংবাদ প্রচারের পর সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্ত জুড়ে কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে এরপর থেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প উপলক্ষ্য করে আসা রোহিঙ্গারা শুণ্য রেখায় আটকা পড়ে।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা এসব রোহিঙ্গারা চরম বিপর্যয়ে পড়ে। শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে অনেক পরিবার খুব বেকায়দায় পড়ে ভেজা ছাড়া কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
এমটি হলেও বাংলাদেশমুখীতা বন্ধ হচ্ছে না। ফলে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আশা রোহিঙ্গা ছাড়াও আজকাল আসা প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা আনজুমান সীমান্তের নাফনদীর তীরে অবস্থান করছে। এখানে গিয়েই কলেরার টিকা খাওয়ানো হয়েছে আগত রোহিঙ্গাদের। মঙ্গলবার বিকেলে সীমান্তে গিয়ে এ পরিস্থিতি দেখা গেছে।
সীমান্তে দায়িত্বপালনকারি বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন রুবেল জানান, পুরোনো এবং চলমান আরাকান সংকট মিলিয়ে প্রায় দশ লাখাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। এ সংখ্যা সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় জনগণের চেয়ে অধিক। এখানে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় অন্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। রোহিঙ্গাদের কারণে পাহাড়গুলো দখল হয়ে গেছে। সাবাড় হচ্ছে গাছপালা। অভয়ারণ্য হারাচ্ছে বন্যপ্রাণী। ফলে হাতিরপালের আক্রমনে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এসব মৃত্যু সরকারের জন্য বিব্রতকর। এটা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক এবং নিষিদ্ধ বস্তু আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনী অনেক রোহিঙ্গাকে অস্ত্র, বোমা ও ইয়াবাসহ আটক করেছে। মানবিকতার সুযোগে এসব অপকর্ম মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মানবিক কিন্তু অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে তিনি ইস্পাত কঠিন। তাই কোন অপরাধী কিংবা অপরাধ কর্মে ব্যবহার্য দ্রব্য বাংলাদেশে আসুক এটা সরকার কখনো চাইনা। নিজেকে বিলিন করে মানবিক হলে অস্থিত্ব সংকটে পড়তে হতে পারে। তাই নতুন কোন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, নতুন করে সীমান্ত পার হতে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে কমকরে হলেও ১৫-২০ হাজার রোহিঙ্গা। এদের থাকার সংস্থান করতে বেগ পেতে হবে। তাই তাদের আটকে রেখে জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তবে, রোহিঙ্গাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত আনজুমানপাড়া সীমান্ত ছাড়াও প্রায় অর্ধশত কিলোমিটারের স্থলসীমান্তের অন্য পয়েন্ট দিয়ে এবং টেকনাফের জলসীমা পার হয়ে অনায়াসে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান নিচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আর নিপীড়নের প্রায় দু’মাস পর আবার বানের স্রোতে রোহিঙ্গা আসা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সচেতন অনেকের প্রশ্ন-পাড়ায় পাড়ায় বিভৎস নির্যাতন হয়ে থাকলে এখন আসা রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষরা এতদিন কোথায় ছিলেন? এরা যদি এত দিন সেখানে নিরাপদে থাকতে পারে তাহলে কি এতদিনের ঘটনা রোহিঙ্গাদের এপারে ঠেলে দিতে সেদেশের সেনা ও রোহিঙ্গাদের সাজানো কোন নাটক?
এসব প্রশ্ন জানতে পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলা হয়। তারা পুরোনোদের মতোই মার-কাট ও নির্যাতনের কাহিনীই শুনিয়েছেন।
রাখাইনের বুচিদং থানার চাংগ্রীবিল গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল (৪৫) বলেন, অনেক চেষ্টা করেছি নিজ ও পার্শবতি গ্রামের লোকজনদের নিয়ে দেশে থাকতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার উগ্র রাখাইনদের অত্যচার নির্যাতনে সেটা সম্ভব হয়নি। ৫একর জমিতে পাক ধরা ধান, দোতলা বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব কিছু ছেড়ে বাংলাদেশেআশ্রয়ের জন্য সীমান্তে এসেছিলাম। কিন্তু দু’দিন ধরে এখানে আটকে আছি। তার মতো অসংখ্য সম্পদশালী রোহিঙ্গা সর্বস্ব হারিয়ে চৌদ্দ পুরুষের ভেটে মাটি ছেড়ে চলে এসেছে।
তার মতো অন্যরাও প্রতিবেশীসহ ঘর থেকে বের হয়ে সাত-আট দিন পাহাড়, জঙ্গল, কাদা, মাড়িয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আসছে বলে দাবি করছেন। আগেরমতো এখানে পৌছেই অনেক মা সন্তান জন্মদিচ্ছেন। নুর বানু তাদের একজন। তিনি রবিবার সকালে খোলা আকাশের নিচে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান সম্ভাবা এসব প্রসূতি হেটে সীমান্তে আসার গল্প সবাইকে ব্যথিত করছে। এরকম বেশ কয়েকজন মাতাকে আঞ্জুমানপাড়ার উত্তর পাড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে এনে পরিচর্যা করছে একটি আইএনজিওর স্বাস্থ্য কর্মী ও ডাক্তারা। সবাই চরম পুষ্টি হীনতা, পানি শূণ্যতাসহ নানা সমস্যায় ভোগছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে সারাদিন দলে দলে অনেক রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে আসছে। এদিকে আসতে না পেরে তীর সংলগ্ন আঞ্জুমানপাড়ার চিংডি ঘেরের বাধ ও ধান খেতের আইলে কাদার মধ্যে ক্লান্ত শরীরে বসে ও শোয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদের অধিকাংশ খাদ্য সংকটের কবলে পড়ে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছের। অনেকে হাঁটা দূরে থাক ঠিক মত দাঁড়াতেও পারছে না।
বুচিডং মান্নানপাড়ার শামশুল আলম (৬০), রাজা বিলের নজির আহমদ (৪০) সহ অসংখ্য রোহিঙ্গা জানান, সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের হাতে একপ্রকার জিম্মি অবস্থায়ও নিজ ঘরে থাকার চেষ্টা করেছি। কোথাও যেতে না পেরে জমানো খাবারসহ প্রয়োজনীয় পণ্যে টান পড়ে। হাট-বাজারে যাওয়া নিষেধ, কাজকর্ম বা ব্যবসা বাণিজ্য নেই। ফলে চরম খাদ্য সংকটে গত ৯ অক্টোবর বুচিডং এর সাংগ্রীবিল, মগনামা, কুয়াংডং, ডাব্রং মং, আলী সংসহ অর্ধ ডজনাধিক গ্রাম থেকে প্রায় ২৫-৩০ হাজারের মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথে অং ঝাই পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে টাকা পয়সা, স্বর্ণাংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে ফেলেছে।
তারা আরো জানায়, নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করা কালে শনিবার রাতে কোয়াংচি বং ক্যাম্পের বিজিপি সদস্যরা এসে তাদেরকে গুলি করার ভয় দেখিয়ে দা-বটিসহ সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়। বলে গেছে তোমাদের বাপদাদার দেশে (বাংলাদেশে) তোমরা দ্রুত চলে যাও। বুচিডং ও রাচিডং অঞ্চলে এখনো জীবিত আরো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতিতে আছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
সেখানে রোহিঙ্গাদের সেবারত আইএনজিও এসিএফের ডিপিএম ইসমাইল ফারুক মানিক জানিয়েছেন, প্রায় ২০ হাজারের মত খিচুড়ির প্যাকেট তারা এখানে বিতরণ করেছে। খিচুড়ি শেষ হওয়ায় পুষ্টি সমৃদ্ব বিস্কুট বিতরণ করা হচ্ছে। আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশুদ্ধ পানি, ইউএনএইচসিআরসহ বেশ কিছু সাহায্য সংস্থা এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে জরুরী ত্রান সামগ্রী বিতরন করছে।
এদিকে শূন্য রেখায় আটকে পড়ার খবর পেয়ে ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া অনেক স্বজন নতুন আসাদের দেখতে বা খাবার দিতে এসে আটকে পড়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। মতলব (৫৮) এদের একজন। বুচিদং থেকে তার মেয়ে ও জামাই আসার খবর পেয়ে বালুখালী ক্যাম্প থেকে ভাত নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তুৃ তার কাছে নিবন্ধনের কোন কার্ড না থাকায় নতুনদের দলের হিসাব করে তাকেও আর ক্যাম্পে যেতে দেয়নি বিজিবি। একই দশায় পড়েছেন কুতুপালং ক্যাম্প থেকে স্বজনদের জন্য খাবার নিয়ে আসা সিরাজ খাতুন (৪০)। তাকেও নতুনদের সাথে সময় কাটাতে হচ্ছে।
এদিকে পালংখালী ইউপির গত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহাদত হোসেন জুয়েল বলেন, সরকার জেলা প্রশাসন ও সেনা সদস্যদের দিয়ে সুশৃংখলভাবে ত্রাণ বিতরণ করার পর থেকে আশ্রয়ে আসা রোহিঙ্গারা নিয়মমাপিক ত্রাণ পাচ্ছেন। এসব রোহিঙ্গারা ওপারে থেকে যাওয়া স্বজনদের ফোন করে এখানে পাওয়া সুযোগ সুবিধার কথা জানিয়ে চলে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে গত একসপ্তাহ ধরে আবারো রোহিঙ্গা আসা বেড়েছে। এছাড়াও সীমান্তের কিছু লোকজন রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাণিজ্য করায় অনুপ্রবেশে সহযোগিতা দেয়। একারণে অনুপ্রবেশ বাধাগ্রস্ত না হয়ে আরো উস্কেযায়।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে আর সুযোগ দেয়া যাবে না। কারণ স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। এতে নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। নানা গুরুতর অপরাধ করতেও দ্বিধা করবে না এসব রোহিঙ্গারা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।