কক্সবাজারের উখিয়ার সর্বত্র সমুদ্র পথে মালয়েশিয়াগামী অসংখ্য মানুষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী পশ্চিম পাড়া এলাকার ছৈয়দুর রহমানের ছেলে মনির আহাম্মদ (৩২) একই এলাকার মানব পাচারকারী দালাল ফরিদ আহাম্মদ ছেলে আবদুর রহিমের প্ররোচনায় মাস দেড়েক পূর্বে সমুদ্র পথে টেকনাফ শাহপূরীর দ্বীপ হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাঁড়ি দেয়। একই সাথে মানব পাচারের ওই দালালের মাধ্যমে বালুখালী পূর্ব পাড়ার আকরাম উল¬াহর ছেলে রুস্তম মিয়া (২৫), পশ্চিম পাড়ার সেকান্দর আলীর ছেলে মুসলিম উদ্দিন (২৮) সহ অন্য জেলার আরো ৫ জন সমুদ্র পাঁড়ি দিয়েছিল। মনির আহাম্মদের স্ত্রী গুল মেহের ও গোল মেহেরের ভাই পালংখালী ইউনিয়নের চৌকিদার নুরুল আলম বলেন, একই সাথে ওই দালালের সাথে ৮ জন মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে বের হলেও মনির আহাম্মদের ২০ দিন ধরে কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। ২০ দিন পূর্বে থাইল্যান্ড থেকে ফোনে মানবপাচারকারীদের বন্দি শিবিরে পৌছানোর সংবাদ জানালেও আর কোন যোগাযোগ হয়নি। ইতিপূর্বে মানব পাচারকারী দালাল আবদুর রহিমের নিকট বসত বন্ধক রেখে ও স্বর্ণালংকার বিক্রি করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেওয়ার পরও মনির আহাম্মদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। মনির আহাম্মদের স্ত্রী গোল মেহের ছোট ছোট ৪ শিশু সন্তান নিয়ে চরম উৎকন্ঠায় কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম হলদিয়ার জাম বাগান এলাকার ইলিয়াছ ভান্ডারী (৪৮) চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা জানিয়ে বলেন, আমার শিশু ছেলে মনজুর আলম (১৪) মরিচ্যাপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে অধ্যায়ন করত। নিয়মিত স্কুল যাতায়াত করে লেখা পড়া চালিয়ে আসছিল। স্কুলের পাশে মরিচ্যা বাজারে বশির কম্পিউটার দোকানে অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে স্কুল ছুটির ফাঁকে গিয়ে ভিডিও গেমস খেলত। এ সুযোগে কম্পিউটার দোকানের মালিক সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের দালাল একই ইউনিয়নের পাগলির বিল গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে বশির আহাম্মদ তার দোকানে আসা যাওয়া করা স্কুল কলেজে শিশু কিশোরদের ফুঁসলিয়ে গোপনে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দিত। একই কায়দায় গত ৩১ মার্চ স্কুল ছুটির কোন এক সময় আমার ছেলেকে সেন্টমার্টিন বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে টেকনাফে নিয়ে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে বিক্রি করে দেয়। ছেলে হারানো ও ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় আমরা উক্ত মানব পাচারকারী বশির আহাম্মদকে বিভিন্ন দফায় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো ছেলেকে ফিরে বা তার কোন সন্ধান পাচ্ছিনা। জানিনা ছেলের ভাগ্যে কি জুটেছে। একই ভাবে উক্ত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য বশির আহাম্মদ কম্পিউটার দোকানের আড়ালে অসংখ্য শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাচার করে রাতারাতি অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে প্রশাসনের সাথে অনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বর্তমানে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে রয়েছে।
জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী গ্রামের মনছুর আহাম্মদের ছেলে ইমরান (১৬) সাগরের চিংড়ি পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। গত ৮ জানুয়ারী সোনার পাড়া এলাকা থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় সোনার পাড়া গ্রামের শামশুল আলম প্রঃ লেইঙ্গা শামশু ও তার ছেলে শাহ জাহান সহ ৪/৫ জন মিলে ইমরানকে অপহরণ করে মালয়েশিয়াগামী ফিশিং বোটে তুলে দেয় বলে ইমরানের পিতা মনছুর আহাম্মদ ও মাতা সাবিনা ইয়াছমিন জানান। পরবর্তীতে খবর পেয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য থাইল্যান্ডে দালালকে দেওয়ার কথা বলে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেক কষ্ট করে ঘর ভিটা বন্ধক রেখে ও ঘরের গরু ছাগল বিক্রি করে এ টাকা দিলেও এ পর্যন্ত নিখোঁজ ছেলে ইমরানের কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা এবং দালাল লেইঙ্গা শামশুকেও পাওয়া যাচ্ছেনা। কয়েকদিন আগে উখিয়া থানায় ছেলে নিখোঁজের ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
উখিয়া সদরের হাজির পাড়া গ্রামের মকবুল আহাম্মদের ছেলে জামাল উদ্দিন (৩০) আমির হোছনের ছেলে আবুল কালাম (২৮)। উভয়ে আপন মামাত ফুফাত ভাই। দু’জনই টেকনাফ থানায় বাবুর্চির কাজ করে সংসার চালাত। টেকনাফ থানার তৎকালীন কনস্টেবল মোঃ ফরিদের প্ররোচনায় ২০১৩ সালের ২২ আগষ্ট মানব পাচারকারী দালাল যিনি ইতিমধ্যে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে সেই ধলু হোছনের মাধ্যমে টেকনাফের শাহপূরীর দ্বীপ থেকে মালয়েশিয়া পাচার হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ কনষ্টেবল ফরিদকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল পাচারকৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের আর কোন খোঁজ মিলেনি বলে জানান, তাদের পিতারা। জামাল উদ্দিনের স্ত্রী হুসনে আরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোট ছোট ৩ শিশু কন্যাকে নিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত খুবই কষ্টে কাটছে। জামালের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিখোঁজের পর থেকে এ পর্যন্ত অনেক ভাবে নিখোঁজ ভাইদের সন্ধানের আশায় চেষ্টা করে অবশেষে তাদের ফিরে পাওয়ার আশা ছেলে দিয়েছি। ওই পুলিশ কনষ্টেবল টেকনাফ থেকে গোপনে বদলী হয়ে কোথায় গেছে তারও আর খোঁজ পাচ্ছিনা।
হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পূর্ব পাতাবাড়ী গ্রামের নুরুল আমিনের ছেলে আকতার কামাল (১৪) স্থানীয় পাতাবাড়ী একটি ওয়ার্কশপের হেলপার হিসাবে কাজ করত। গত ১৯ মার্চ দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার পথে একই ইউনিয়নের পূর্ব হলদিয়াপালংয়ের মকবুল আহাম্মদ (৪৫), জাফর আলম সওদাগরের ছেলে আবুল আজম প্রঃ আব্বুইয়া (৩৩) ও মোঃ বেদাইয়া তাকে সহ স্থানীয় একই গ্রামের আলী আহাম্মদের ছেলে মোঃ আলী (১৬), মৃত ছৈয়দ আলমের ছেলে মোঃ শাহ জাহান (১৫) সহ আরো কয়েকজন সহ একটি মাইক্রো বাসে উঠিয়ে উখিয়ার সোনার পাড়া রেজু খাল দিয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাচার করে দেয় বলে নুরুল আমিন জানান। মোঃ শাহ জাহানের মাতা রুমা আকতার কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমরা গরীব, অসহায় এবং এতিম বিধায় আমাদের কথা কেউ শুনেনা। আমার একমাত্র অবলম্বন ছেলেটি কোথায় গেছে আদৌ বেঁচে আছে কিনা খোঁজ পাচ্ছিনা। দালালরা তাদেরকে থাইল্যান্ড জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের কবল থেকে ফিরিয়ে আনার আশ্বাসে জনপ্রতি ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে দাবী করলে এ পর্যন্ত দাবীকৃত টাকা দিতে অক্ষম হওয়ায় কোন কুল কিনারা করতে পারছেনা বলে পাচার হয়ে যাওয়া ছেলেদের অভিভাবকরা জানান।
এ ধরনের মালয়েশিয়া পাচার, অপহরণ, জিম্মি ও মুক্তিপন আদায়ের পরও অসংখ্য জীবন্ত মানুষের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পরিবারের লোকজন তাদের কোন সন্ধান বা খোঁজ পাচ্ছেনা। উখিয়ার বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য মানুষ পাচারের শিকার হলেও আবার অনেকে স্বেচ্ছায় দালালের হাত ধরে জীবনের গতি পাল্টাতে রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ায় সোনার হরিণ ধরতে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেক মানুষের সমুদ্রে সলিল সমাধি, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জিম্মি বন্দি শিবিরে অভূক্ত থেকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়ে হয়ত ঠাঁই হয়েছে কোন এক গণকবরে। তার পরেও পরিবারের নিকটাত্মীয়দের প্রত্যাশা আখাংকা হয়ত তাদের ছেলে, ভাই, স্বামী বা পিতা একদিন ফিরে আসবে। উখিয়া থানার ওসি জহিরুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ ও পাচার হয়ে যাওয়াদের সংবাদ আসছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।