আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাই পাস করে আসতে পারবেন না— এলাকায় নেতা-কর্মীবিমুখ ও জনবিচ্ছিন্ন এমন এমপিদের আগামী নির্বাচনে নৌকায় না তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন্দ্র থেকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে এমপিদের নির্বাচনী এলাকায়। ইতিমধ্যে ৫০ জন এমপির ব্যাপারে চরম নেতিবাচক বার্তা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে। এই এমপিরা এলাকা ও দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। মাঝে মাঝে ঘুরে আসেন নিজের বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কাউকেই সময় দেন না। জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে তাদের। এসব আসনের জন্য বিকল্প প্রার্থী সন্ধান করা হচ্ছে। ১৮০ জনের মতো এমপি এলাকার সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখেন। অনেকে শুক্র-শনিবার দুই দিন এলাকায় মাঠ চষে বেড়ান। কেউ কেউ আরও বেশি সময় এলাকায় থাকেন। নিয়মিত উঠান বৈঠকেও যোগ দিচ্ছেন। দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
দলীয় সূত্রমতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কোন কোন আসন নিশ্চিত ও অনিশ্চিত তা নির্ণয়ের কাজ চলছে। দলের হাইকমান্ড যেসব আসনের ক্ষেত্রে স্থির বিশ্বাসী হবেন, সেগুলো ছাড়া বাকিগুলো নিয়ে হিসাব-নিকাশ করা হবে। বিতর্কিত, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন এমপিরা ফের দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। বিপরীতে উন্নয়ন, জনকল্যাণকর কাজ, দলে অবদান এবং তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। এসব নেতাকে প্রার্থী করেই সাজানো হবে পরবর্তী নির্বাচনের ছক। আবার এলাকায় গ্রুপিং সৃষ্টি করে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করা প্রার্থীদের বিষয়েও সতর্ক রয়েছে কেন্দ্র। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে হলে এলাকামুখী হও— এই বারতা দেওয়া হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে। এলাকাবিমুখ এমপি ও নেতারা মনোনয়ন পাবেন না— এ কথা সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলের হাইকমান্ড থেকে বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বলা হয়েছে— এলাকায় যাও, মনোনয়ন নাও। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ািম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের এলাকামুখী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় আসতে হলে জনগণের মন জয় করেই আসতে হবে। এজন্য যারা এলাকাবিমুখ, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন ২০১৮ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হবে না। এ কারণে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দলের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন। জেলা পর্যায়ে জনসভা করছেন নিয়মিত। আজও মাগুরায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করবেন তিনি। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও আগে থেকেই ছিলেন কর্মীবান্ধব। এখনো সারা দেশ নেতা-কর্মীর সঙ্গে সময় কাটে তার। দলকে চাঙ্গা করে তুলছেন তিনি। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডেকে তাদের সংশোধন হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন; না হলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। দলীয় সূত্র জানায়, তার পরও অনেক এমপির কার্যক্রম নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে প্রশ্ন রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে নির্বাচনী এলাকায় বাণিজ্যের অভিযোগ। কাবিখা থেকে শুরু করে জমি দখলও বাদ নেই। অনেকে শুধু বিচ্ছিন্নই নন, নেতা-কর্মীবিচ্ছিন্নও। দলকে পরিণত করেছেন ‘ব্যক্তি লীগে’। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা ভিড়তে পারেন না তাদের কাছে। এসব এমপির কাছে হাইব্রিডদের কদর সর্বাগ্রে। কেউ কেউ আবার দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে ও বউয়ের আত্মীয়স্বজন দিয়ে দল পরিচালনা করছেন এলাকায়। বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবতা বুঝেই আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ৩০০ আসনের নির্বাচনে কারও এলাকায় দলের কেন্দ্রের অবস্থান নেওয়ার সময় থাকবে না ভোটের সময়। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি না থাকলে সমস্যা তৈরি হবে। মনোনয়নের বাইরে রাখতে হবে বিতর্কিতদের। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বেশ কজন নেতা বলছেন, দলের মাথায় এখন শুধু আগামী নির্বাচন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ক্ষমতার ধারাবাহিকতাও চান তারা। আর বিএনপি যে কোনো চাপের মুখে থাকলেও আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। তাই জনপ্রিয় প্রার্থী ছাড়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশ বেকায়দায় পড়বে, এমন চিন্তা শাসক দলের হাইকমান্ডের। তবে বর্তমান অনেক এমপি যারা ইতিমধ্যে নিজের বলয় সৃষ্টি করে ফেলেছেন, মনোনয়ন না পেলে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হতে পারেন তাদের হাত থেকে দলীয় রাজনীতি বের করার চেষ্টাও হবে বিভিন্ন উপায়ে। একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত তৃণমূলে খোঁজখবর রাখছেন। বিভিন্ন জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অনেক সময় তিনি যোগাযোগ করেন। দলের জরিপে উঠে এসেছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে ‘তৃণমূল’। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সামাল দেওয়ার কাজ করছেন ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমাদের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ। আরেকটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের এলাকায় গিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব থাকলে তা নিরসন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মাধ্যমে এমপিদের কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর রাখছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। ’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।