বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের জন্য বিস্তারিত প্রস্তাব তৈরি করছে বিএনপি। এই সময়ের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ‘ডাবল ডিজিটে’ উন্নীত করার ‘সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত’ উদ্যোগ নিয়ে দলটি। এছাড়া ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যেও বড় ধরনের পরিবর্তন করতে চায়। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট ও প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার পক্ষে তারা। বিষয়গুলোর একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে বিএনপির গত ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলীয় কাউন্সিলেই। ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মনে করছে, ‘ভিশন ২০৩০’ না হয়ে ‘২০৫০’ হলে আরও দূরদর্শী হতো। যদিও এ নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন কেউ। ১০মে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর ১৮ বা ২০ মে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা একটি ঘরোয়া বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকেই ‘ভিশন ২০৩০’-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান বিএনপিপন্থী একজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী। তারা বলছেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে ইশতেহারে ‘রূপকল্প-২০৪১’ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘রূপকল্প-২০২১’ শিরোনামে ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। ফলে, বিএনপির ভিশন ২০৩০ সময়সীমা রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে।
তবে এ প্রসঙ্গে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের পরই এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’
উল্লেখ্য, গত বছর কাউন্সিলে ভিশন ২০৩০ প্রাথমিক ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন দল সমালোচনা করে বলেছিল, আওয়ামী লীগের ‘রূপকল্প’ অনুসরণ করেই বিএনপি ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো ২০১৭ সালে বসে ২০৪১ দেখতে পারছি না। এই সময় অনেক দূর এবং এরমধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটবে। এটা হয়তো শেখ হাসিনা দেখতে পান, তাই ২০৪১ রূপকল্প দিয়েছেন। আমরা এই সময়ে বসে আগামী দুটি নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করছি।’
বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’-এর প্রধান দিকগুলো
বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’-এর একটি প্রাথমিক ধারণা খালেদা জিয়া গত বছর কাউন্সিলে দিয়েছেন। ওই সময় তিনি বলেছেন, ‘‘দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও অঙ্গনে কর্মরত শীর্ষস্থানীয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। সবার সুচিন্তিত অভিমত ও পরামর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধ দেশ ও আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিএনপি ইতোমধ্যেই ‘ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেছে।’’
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ‘ভিশন ২০৩০’ কী কী থাকবে, বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে কী কী কাজ করবে, দেশকে কিভাবে উন্নত করবে, সেগুলোই শুধু খালেদা জিয়া ১০ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে জানাবেন। তবে এই প্রস্তাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ও সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে না বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাব করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে, সেই লক্ষ্যেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে যথাসময়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করব।’
কাউন্সিলে দেওয়া খালেদা জিয়ার বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’-এর মূল দিক দু’টি। একটি ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। এরজন্য বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ‘ডবল ডিজিটে’ উন্নীত করার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এক্ষেত্রে সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা।
এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে, প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের ছদ্মাবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানীগুণী ও মেধাবীদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমাদের জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই সরকারের আমলে করা বিভিন্ন আইনের বিষয়েও ভিশনে পরিবর্তনের কথা থাকবে। বিভিন্ন বিতর্কিত আইন বাতিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আটক অবস্থায় দৈহিক-মানসিক নির্যাতন বন্ধের প্রস্তাব থাকবে বিএনপির ভিশনে।
‘ভিশন ২০৩০’-এ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদ্ধতি সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং নিয়োগের জন্য বাছাই বা সুপারিশকৃতদের ব্যক্তিগত তথ্য ও সম্পদবিবরণী জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার কথা বলা হবে। ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে সেই কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা এবং সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় থাকবে ‘ভিশন ২০৩০’-এ।
বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের মধ্যে কোনও রকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বরদাস্ত না করার অঙ্গীকার করা হবে ভিশনে। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাদক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হবে সংবাদ সম্মেলনে। এ প্রসঙ্গে গত বছরই খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এই ভিশনের আলোকেই আগামীতে আমাদের দলের নির্বাচনি ইশতেহার রচিত হবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।