‘ক্ষমতাসীনদলের নাম ব্যবহার করে সরকারি ভুমিদখল, বিরোধী জোটের লোকজনকে মিথ্যা মামলা জড়িয়ে হয়রানি, মারধর, থানায় দালালিসহ নানা অপকর্মের পর এবার মানবপাচার মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে ক্ষমতাসীনদল যুবলীগের সভাপতি আবদুল্লাহ বিদ্যুৎকে। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে জেল-হাজতে প্রেরন করেন। তাকে কারাগারে প্রেরনের বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে খুশির আমেজ। অনেকেই মনে করছেন ‘ক্ষমতায় থাকলেও অপরাধ করলে জেলে যেতে হবে। এমন অভিমত সংশ্লিষ্ট মহলের।
গত শনিবার রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মানবপাচার মামলার পলাতক আসামি আবদুল্লাহ বিদ্যুৎকে কক্সবাজার শহরের লালদিঘী এলাকার হোটেল নিদমহলের সামনে থেকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নের (র্যাব) সদস্যরা।
আবদুল্লাহ বিদ্যুৎ রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের কম্বনিয়া এলাকার মো. ফেরদৌসের ছেলে।
টেকনাফ থানার উপ-পরিদর্শক ও মামলা তদন্তকারি কর্মকর্তা (এসআই) শামীউর রহমান রোববার আবদুল্লাহ বিদ্যুৎ’র আটকের বিষয় নিয়ে কোর্ট পরিদর্শক বরাবরে আবেদনে উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও তাকে আটক করা যায়নি। শনিবার র্যাব তাকে কক্সবাজার শহরে থেকে আটক করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সোর্পদ করেন। যার কারনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি।
তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, মামলার সুষ্টু তদন্তের স্বার্থে তাকে জেলে রাখা প্রয়োজন।
সহজেই জামিন পেলে এলাকায় ফিরে আবার মানবপাচারে জড়িয়ে পড়বে বলে এই আবেদনে উল্লেখ করেন।
টেকনাফ থানার উপ-পরিদর্শক ও মামলা তদন্তকারি কর্মকর্তা (এসআই) শামীউর রহমান জানান, নিশ্চয় তাকে রিমান্ড চাওয়া হবে। সে যতই ক্ষমতাবান হউক না কেন তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে স্থানীয় এলাকাবাসি জানিয়েছেন, মানবপাচারকারির ডন আবদুল্লাহ বিদ্যুৎকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অর্ধশতাধিক মানবপাচারকারি নাম ঠিকানা পাওয়া যাবে।
অপর দিকে তার আটকের খবর পেয়ে তার অর্ধশতাধিক সহযোগি আতœগোপনে চলে গেছে। এরা হলেন. রামু উপজেলার খুনিয়া পালং ইউনিয়নের আব্দুর রহমানের ছেলে মাহমুদুল করিম, মো: কালুর ছেলে নুরুল কবির বাদশা, ধোয়াপালংয়ের বেলাল প্রকাশ গাছ বেলাল, দারিয়ারদিঘি গ্রামের মৃত নজির আহম্মদের ছেলে মফিজুর রহমান, উত্তর বড়বিল গ্রামের মৃত বোবা কালুর ছেলে মো: এরশাদ, চাকমারকুলের মৃত নুরুল হকের পুত্র মৌলবী আমিন উল্লাহ, পেঁচারদ্বীপ গ্রামের মৃত পেঠান আলীর ছেলে আব্দুল গফুর, মৃত আলী আহমদের ছেলে ছুরুত আলম, মৃত ফকির আহমদের ছেলে মো: জাফর আলম, মীর কাসেমের ছেলে ছৈয়দ আলম বদু ও হিমছড়ি মৃত মছন আলীর ছেলে মির কাসেম, কেচুবনিয়া কাওয়ার খোলা গ্রামের বাচা মিয়ার ছেলে নুুরুল হক, মাহমুদুল হক, পূর্ব গোয়ালিয়ার মৃত শাহজানের ছেলে দাড়ি আবুল কালাম, মধ্য হলদিয়া গ্রামের জাফর আলমের ছেলে নজরুল ইসলাম বাবু।
মামলার বাদী সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ডের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার রশিদ আহমদ জানান, ১৩ মে তিনি বাদী হয়ে টেকনাফ মানবপাচার আইনে ৪০ জন আসামির নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। যার ৩৪ নম্বর আসামি আবদুল্লাহ বিদ্যুৎ।
প্রসঙ্গত: রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দিনমজুর ফেরদৌসের বড় ছেলে মো. আব্দুল্লাহ (৪২)। এক সময় ইলেক্ট্রিকের কাজ করতেন বলে এলাকার লোকজন তাকে আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎ বলে ডাকেন।
আট বছর আগের আব্দুল্লাহ বর্তমানে মানবপাচারকারী চক্রের ডন। এ কাজ করে তিনি গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার সম্পত্তি।
নিরক্ষর আব্দুল্লাহ ২০০৮ সাল পর্যন্ত উখিয়া উপজেলার সোনাপাড়ার সৌদিয়া হ্যাচারিতে ইলেক্ট্রিকের কাজ করতেন। বেতন ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ওই বছরেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাম লেখান রাজনীতিতে। এরপর থেকেই তার দৃশ্যমান কোন পেশা নেই। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে অল্প সময়েই হয়ে উঠেন খুনিয়াপালং ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। এরপর থেকেই বেপোরোয়া হতে শুরু করেন আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎ। এক সময় গোপনে পাচারকারীদের সহযোগিতা করলেও সভাপতি হওয়ার পর হয়ে উঠেন বেপোরোয়া। একে একে নিয়ন্ত্রণে নেন ১২জন পাচারকারীকে। আইনের হাত থেকে পাচারকারীদের বাঁচাতে শুরু করেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
দরিদ্র পরিবারের ছেলে আব্দুল্লাহ আলিশানভাবে জীবনযাপন শুরু করেন। কমুবনিয়ার সরকারি বনভূমির ১০ একর জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার জন্য ইট, বালি মজুদ করেছেন। ইজারা নিয়েছেন হিমছড়ি পার্ক। হিমছড়ি এলাকাতেই কিনেছেন কোটি টাকা মূল্যের জায়গা। নিজ ইউনিয়নের লোকজনের কাছ থেকে বন্ধক নিয়েছেন অর্ধকোটি টাকার জায়গা জমি। নিজের জন্য একটি ও ছোট দুইভাই আব্দুস সালাম ও আব্দুল কাদেরের জন্য কিনেছেন দু’টি এফ জেট মোটরসাইকেল। পাচারকারীদের কাছ থেকে নেওয়া কমিশন ও নিজের গ্রুপের পাচারের টাকায় এ সম্পত্তি কেনা।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে পেঁচার দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। সড়কের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বে উঁচু উঁচু পাহাড়ের আড়ালেই থাকেন এক ডজন মানবপাচারকারী চক্র। এর আটটি পয়েন্ট দিয়ে এক ডজন গ্রুপের হয়ে কাজ করেন আরো শতাধিক পাচারকারী। আর এই ১২টি গ্রুপের শতাধিক পাচারকারী চক্রের ক্ষমতাধর গডফাদারের নাম আব্দুল্লাহ বিদ্যুৎ।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।