শীতকাল শুরু হয়েছে সপ্তাহ দু-এক আগে। বাংলাদেশের শীতলতম মাস জানুয়ারি।
পৃথিবীর বার্ষিক গতির নিয়মে এখন সেই মাস চলছে। শীতের রাতগুলো দীর্ঘ হয়। একেবারে হিমশীতল নির্জন রাত, কী গ্রাম, কী শহর! নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হতে চায় না। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই পশুপাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। রাতের নিস্তব্ধতায় সামান্য ঝিঁঝি পোকার ডাকও অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। আলো ঝলমলে দিনের সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ হয়। কিন্তু রাতেরও যে সৌন্দর্য আছে সেটা আমরা খুব কম মানুষই জানি। শীতের রাতগুলো অসম্ভব সুন্দর। শীতের রাত নিয়ে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন—
‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো’
জীবনানন্দ দাশের সেই শিশির কিংবা পাতা ঝরা অসম্ভব সুন্দর শীতের রাতে পড়ার ঘরে বসে আছি আমি। এখানেও গভীর রাতে গাছের পাতায় শিশিরের শব্দ পাই। কাচের টেবিলে খাতা-কলম রাখা। প্রাণের সংগঠন ছাত্রলীগের জন্মদিন, ব্যস্ততার ফাঁকেও কিছু লিখতে হবে। লিখতে বসে যতবারই মনে হচ্ছে, এমনই সুন্দর কোনো এক পৌষের রাতেই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল দুঃখী বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের হাতিয়ার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, মনটা আনন্দে ভরে যায়। ছাত্রলীগ তো শুধু একটি ছাত্রসংগঠন নয়, মহাকালের ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি নাম। একটি স্বাধীন জাতির সব অর্জনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে তার নাম।
২.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। তখন আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের শোষণ করতে চেয়েছে বারবার। যে রাষ্ট্র গঠনে আমাদেরও ভূমিকা ছিল, রাতারাতি তারা যেন হয়ে গেল সেই রাষ্ট্রের মালিক, আমরা নগণ্য প্রজা। তাদের সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়েছি আমরা। বঞ্চিত হয়েছি মৌলিক অধিকার থেকেও। সেই শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় আর শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করতে সময়ের দাবিতেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রসমাজের ডাকা হরতালের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবদান রাখতে শুরু করে। এরপর ১৯৫১ সালের আদমশুমারি চলাকালে সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাংলা ভাষার পক্ষে মতামত দিতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনী প্রচারে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ছাত্রলীগই প্রথম রাজপথে সোচ্চার হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ছাত্রলীগের ১১ দফা, অতঃপর ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হতে ছাত্রলীগের অবদান ছিল মাইলফলক। এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাড়ে ১৭ হাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আত্মাহুতি দিয়েছে। এই গৌরব পৃথিবীর আর কোনো ছাত্রসংগঠনের আছে কি না আমার জানা নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর পিতাহীন বাংলাদেশ বারবার গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। সে সময়গুলোতেও ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছে। ১-১১-র অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলামের নৈরাজ্য, বিএনপির আগুন-সন্ত্রাস, জামায়াতের জঙ্গি তত্পরতা ঠেকাতে সোচ্চার ছিল ছাত্রলীগই। এ ছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পাহারা দিয়েছে পূজামণ্ডপ, করেছে রাস্তা মেরামতের কাজও, পরিবেশ রক্ষার জন্য লাগিয়েছে হাজার হাজার গাছ। দাঁড়িয়েছে বন্যার্ত, শীতার্ত মানুষের পাশে। কখনো করেছে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, আবার কখনো ছুটে গেছে কোনো অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। আসলে সব সময় ভালো কিছু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
৩.
একটি জাতি, শিক্ষাদীক্ষায় যত এগিয়ে উন্নয়নেও তত এগিয়ে। শুধু তা-ই নয়, উন্নয়নকে ফলপ্রসূ ও উন্নয়নের শতভাগ সুবিধা সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে সবার আগে দরকার শিক্ষিত জনগণ। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিটি সেক্টরে উন্নয়নের জোয়ার চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শুরু করে যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তিসহ সব খাতে চলছে সেই জোয়ার। উন্নয়নের সব সূচকে এরই মধ্যে আমরা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলেছি। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, সামনের দিনগুলোতে যে ১০টি দেশ বিশ্ব-অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করবে তাদের একটি হবে বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে যে উন্নয়ন চলছে সেটাকে আরো কার্যকর করতে শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। সরকার এর মধ্যেই বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে। পাশাপাশি জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিয়েছেন সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে। আমরাও নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা এরই মধ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ২০১৭ সালকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ‘নিরক্ষরতামুক্ত বছর’ ঘোষণা করা হয়েছে। বছরের শুরু থেকেই পুরোদমে কাজ করে যাব আমরা। আমাদের কার্যক্রম যেন একেবারে জেলা-উপজেলা থেকে ইউনিয়ন ও প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছায়, সে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ থেকে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন টিম করে দেওয়া হবে কাজ সঠিকভাবে তদারকির জন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে আন্দোলন শুরু করেছেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।
৪.
আজ লাখো তারুণ্যের প্রাণের উচ্ছ্বাস, আবেগ, ভালোবাসা আর ভালো লাগার সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৯তম জন্মদিন। ছাত্রলীগের জন্ম না হলে কখনোই বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস নির্মিত হতো না। কখনোই সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে রঞ্জিত হতো না রাজপথ। গুমরে কাঁদত মানবতা। এ জন্যই জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। ’ শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। অতীতের মতো তোমার হাত ধরেই রচিত হোক মহাকালের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় পাতায় অক্ষয় হোক তোমার নাম।
শুভেচ্ছা অফুরান। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।