জঙ্গিবাদ কোনো দেশের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে এখন সীমাবদ্ধ নেই। অনলাইনের ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি মতাদর্শ। যেখানে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নেই সেখানেও নাশকতার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ কারণে ১৯০টি দেশে আন্তর্দেশীয় নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল। ইতিমধ্যে ৬০ দেশের তথ্যভাণ্ডার (ডাটাবেইস) তৈরির কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। ইন্টারপোল ছাড়াও ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), আসিয়ানপোল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং অ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রাম (আইসিআইটিএপি), অনলাইন সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জঙ্গিবিরোধী নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম চালাতে পারবে। কোনো দেশে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা ভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকলেও তাদের আইনের আওতায় আনা সহজতর হবে।
গতকাল রবিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে চিফ অব পুলিশ কনফারেন্স অব সাউথ এশিয়া অ্যান্ড নেইবারিং কান্ট্রিস অন রিজিওনাল কো-অপারেশন ইন কার্ভিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম সম্মেলনে সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানান। বাংলাদেশ পুলিশ ও ইন্টারপোলের যৌথ আয়োজনে প্রথমবারের মতো এ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও পার্শ্ববর্তী ১৪ দেশের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিচ্ছেন। তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের গতকাল ছিল প্রথম দিন।
সম্মেলনে ইন্টারপোল মহাসচিব জারগেন স্টকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। ভিন্ন দেশ ও সংস্থার মধ্যে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন তাঁরা। সাইবার ক্রাইম, অর্থনৈতিক অপরাধ, সন্ত্রাসী অর্থায়ন, মাদকদ্রব্য পাচার রোধ, অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধ, সংগঠিত অপরাধের মতোই জঙ্গিবাদ নির্মূলে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন পুলিশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও জঙ্গিবাদ দমনে একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কোনো সীমানা নেই। জঙ্গিদের ভার্চুয়াল উপস্থিতি কোনো সীমান্ত মানে না। এখন শুধু নিজের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়। যৌথভাবেই তাদের মুকাবিলা করতে হবে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মুকাবিলা সরকারের একার কাজ নয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সরকারের জিরো টলারেন্সের নীতি। খুন, গুম, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমরা বদ্ধপরিকর। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ’
ইন্টারপোলের মহাসচিব জারগেন স্টক বলেছেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তথ্য বিনিময়ে অভিন্ন আন্তর্দেশীয় নেটওয়ার্ক তৈরিতে ইন্টারপোল কাজ করছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তথ্য আদান-প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্দেশীয় যেকোনো অপরাধ মোকাবেলায় তথ্য আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। এক দেশের অস্ত্র ও জঙ্গি অন্য দেশের মানুষ হত্যায় ব্যবহৃত হতে পারে। তাই যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার পর ইন্টারপোল তথ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। কাউন্টার টেররিজমে বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা অর্জনে ইন্টারপোল সহযোগিতা করেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ইন্টারপোলের মহাসচিব। তিনি বলেন, এই সম্মেলন গ্লোবাল পুলিশিং কার্যক্রমকে বেগবান করবে। ইন্টারপোল জঙ্গিবাদ, সংগঠিত অপরাধ, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। ১৯০টি দেশে ইন্টারপোলের কাজ চলছে। এখনকার সময়ে গ্লোবাল পুলিশিংয়ের জন্য তথ্য-অভিজ্ঞতা বিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, গত বছর গুলশানের হামলার পর বাংলাদেশ পুলিশের তদন্ত সফলতা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ইতিবাচক। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদসহ অন্তর্দেশীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে গ্লোবাল পুলিশিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। ৬০টি দেশে ডাটাবেইস তৈরি করা হচ্ছে। গ্লোবাল পুলিশিংয়ে সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের জন্য সরকার ইন্টারপোলের কাছে তথ্য দেয়, এর পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারপোল বিরোধী দলের লোকজনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জারগেন স্টক বলেন, প্রতিটি তথ্য প্রদানের সময় তাঁরা পুরো প্রক্রিয়া মূল্যায়ন করে থাকেন। এরপর রিভিউ করা হয়। যেসব স্থানে অসংগতি বা সমস্যা থাকে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়। একটি রেড নোটিশ বাদও দেওয়া হয়েছে।
সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান কমিউনিকেশন’ চ্যানেল তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য প্রতিবেশী দেশের পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ। বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমকে বেগবান করতে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য পুলিশে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়া হয়। এ জন্য আমরা ফেসবুককে আমাদের এ কার্যক্রমে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এফবিআই তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতাসম্পন্ন। এ কারণে তাদেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। আসিয়ানপোল এ অঞ্চলের পুলিশিং বিষয়ে কাজ করে। তারাও এ উদ্যোগে অংশ নিয়েছে। ’
যৌথ কার্যক্রমের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আইজিপি বলেন, ‘যারা অন্য দেশে আছে সেসব সন্ত্রাসীর বিষয়ে আমরা তথ্য চাইব। ’ সীমান্ত অপরাধের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ব্যাপারে পুলিশ একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করতে একত্র হয়েছি। ’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহেমদ, পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোখলেসুর রহমান প্রমুখ।
গতকাল সম্মেলনের প্রথম দিনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রন্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম ও সিঙ্গাপুরের নানিয়ং টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের (আইসিপিভিটিআর) অধ্যাপক ড. রোহান গুনারত্নে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তিন দিনের এ সম্মেলনে ১৪টি কর্ম অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। জঙ্গিবাদ দমন, মানবপাচার, অর্থনৈতিক অপরাধ এবং সন্ত্রাসী অর্থায়ন, মাদকদ্রব্য পাচার রোধ, অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধ, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় স্থান পাবে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনাই, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনামের পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনে আফগানিস্তানের নিরাপত্তাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপমন্ত্রী আবদুর রহমান, মালয়েশিয়ার আইজিপি খালিদ আবু বকর, মিয়ানমার পুলিশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মায়ো সু উইন, দক্ষিণ কোরিয়ার সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট জু মিন লি, শ্রীলঙ্কার আইজিপি পুজিথ সন্ধি বন্দরা জয়সুন্দর, আসিয়ানপোলের নির্বাহী পরিচালক ইয়োহানেস আগুস মুলিয়োনো, আইজিসিআইর প্রটোকল অ্যান্ড কনফারেন্স বিভাগের প্রধান সিন লি চুয়া, আইসিআইটিএপির পরিচালক গ্রে বারসহ ৫৮ জন বিদেশি অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনের শেষ দিনে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনসহ আন্তর্দেশীয় অপরাধ দমনে ‘যৌথ ঘোষণা’ স্বাক্ষর হবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।