২৫ নভেম্বর, ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  ব্যাটারী চালিত ই-বাইক মালিক সমিতি মরিচ্যা ও মৌলভী পাড়া কমিটি অনুমোদন   ●  টেকনাফ সমুদ্রে গোসলে নেমে মাদ্রাসার এক ছাত্রের মৃত্যু দুই ছাত্র নিখোঁজ।   ●  মাকে হত্যার পর থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ।   ●  মারমেইড বীচ রিসোর্টে বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান   ●  যারা খেলাধূলা করছে, তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না   ●  উখিয়ার নতুন ইউএনও কামরুল হাসান চৌধুরী   ●  উখিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার   ●  ছয় কোটি তরুণের দেয়াল লিখন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান   ●  চকরিয়ায় ২টি ডাম্পার ট্রাক ও এক্সকেভেটর জব্দ   ●  ধরে নিয়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশী  জেলেকে ফেরত দিল আরাকান আর্মি

জেলা কারাগারে ঢুকলেই ইয়াবা ব্যবসায়ী হয় ভাগ্যবান!

৩3

কক্সবাজার জেলা কারাগারের হাসপাতালটি সরকারের তরফ থেকে বন্দিদের জন্য দেওয়া অনেক বড় উপহার। বিভিন্ন অপরাধে প্রতিদিন কক্সবাজার জেলা কারাগারে যাচ্ছে প্রভাবশালী, বিত্তশালী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী কিংবা সাধারণ অপরাধী। এখানে ডুকলেই প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা ইয়াবা ব্যবসায়ীরা হয় ভাগ্যবান;। কারা হাসপাতালে রোগী দেখা হয় ১০ভাগ। বিভিন্ন কায়দায় কারাহাসপাতালে চিকিৎসার নামে ওপেন সিক্রেটে দূর্নীতি আর অনিয়ম হচ্ছে ৯০ভাগ।
কক্সবাজার জেলা কারা হাসপাতালটি এখন আবাসিক হোটেলে পরিণত হয়েছে এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাসিক ও দৈনিক নগদ অর্থ দিয়ে হাসপাতালের সব’কটি বেড প্রভাবশালী ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিকট অলিখিত ভাবে বিক্রি করে দিয়েছে । অসুস্থ রোগীরা কারা হাসপাতালের চিকিৎসা পাচ্ছে না। রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে জেলা সদর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
কক্সবাজার জেলা কারা হাসপাতালে ১জন সহকারী সিভিল সার্জন, ১জন ফার্মাসিষ্ট এর পদ রয়েছে। কিন্তু সহকারী সিভিল সার্জন এর পদটি শুন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ১ জন অঘোষিত মেডিক্যাল রাইটার রয়েছে। এ জেলা কারা হাসপাতালে রয়েছে মোটামুটি ধরণের ফার্মেসী। এই কারা হাসপাতালের ফার্মেসীতে ঔষধ পাওয়া খুবই দুসাধ্য ব্যাপার।
কামালা নামের এক কয়েদী ( ছদ্ম নাম) সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তিপান। দিনি জানালেন, কারা হাসপাতালের দূর্নীতির প্রথম স্তর হলো রোগীর বদলে মক্কেল রাখা। কারা হাসপাতালে মক্কেল রাখাটা মক্কেল (ধনী বন্দি) থাকতে হলে তাকে ৬০০০ টাকা আর খাবারের জন্য সপ্তাহিক ১০০০ টাকা দিতে হচ্ছে। এই টাকায় দৈনিক দুপুরে আলাদা আলু ভর্তা, শাকভাজী ও ডাল দিয়ে ভাল ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। মক্কেলের মাসিক ৬০০০-১০০০০ টাকার মাধ্যে ডাক্তার কিংবা ফার্মাসিষ্ট পাচ্ছে ৪০০০ টাকা, রাইটার ১০০০ টাকা । বাকী টাকা প্রশাসনের জন্য রেখে দেওয়া হচ্ছে। কারা হাসপাতালে লক-আপ হতো ২০০-২৫০ জন তার মধ্যে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা থাকতো ১০০ জন। বাকী ১৫০ জন মক্কেল। তবে জেলা কারা হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত নয় বলে এর চাহিদাও খুব যে বেশী তা নয়। তবুও অনেক বন্দিই মনে করেন কারা হাসপাতালে থাকলে বোধ করি আরামে থাকা যাবে।
ফরিদ নামের আরেক হাজতী ( ছদ্ম নাম) জানান, কারা হাসপাতালে রয়েছে জলভরী। পানির ব্যবস্থা করে মক্কেলের গোসল করিয়ে দেবে কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে দিয়ে যাবে। প্রতি মক্কেলকে সাপ্তাহিক ৮০০ থেকে ১০০০/- টাকা জলভরীদের দিতে হবে। জলভরী হলো কয়েদী বন্দি যারা পানি টানে তারা। এই জেলা কারা হাসপাতালের দূর্ণীতির আরেকটি বড় মাধ্যম হলো বাহির মেডিক্যালে পাঠানো। প্রকৃত রোগী যতনা যায় তার-চেয়ে বেশী মক্কেলগণ বাহির মেডিক্যালে যায় চিকিৎসার জন্য। বাহির মেডিক্যাল বলতে জেলা সদর হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে। কারাগারের চার দেয়ালে ধনী, ইয়াবা ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক বন্দিগণ থাকতে চান না। তারা একটা মুক্ত হাওয়া চান। সেই সাথে আপন জনদের সাথে দেখা শুনা; ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রস্তাব যায় রাইটারের মাধ্যমে ডাক্তার কিংবা ফার্মাসিষ্ট হামিদের দরবারে। ডাক্তার শুনেন বুঝেন কোন কারণ দেখিয়ে মক্কেলকে বাহির মেডিক্যালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন।
তিনি বলেন, বাহির মেডিকেল যেতে মিউনিট তৈরী করতে ডাক্তারদের জন্য দিতে হয় ১০/১৫ হাজার, রাইটার ও ফার্মাসিষ্ট হামিদকে ৫ হাজার, প্রশাসন ৫ হাজার সব মিলিয়ে ৩০ হাজার হলে বাহির মেডিক্যাল যাওয়া যায়। ডাক্তারদের টাকা ভাগাভাগি হয় সিভিল সার্জন ও দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী সিভিল সার্জন। সিভিল সার্জনকে দিতে হয় এ জন্য যে, যেহেতু আইনানুগভাবে সরকারী হাসপাতালের যে কোন বোর্ড সিদ্ধান্ত নিতে হলে সিভিল সার্জনের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক সেক্ষেত্রে টাকার ভাগ তাকেও দিতে হয়।
একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, বাহির মেডিক্যালে যত রোগী যায় তাদের ভালোভাবে সতর্ককতার সাথে নিরীক্ষন করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা শতকরা ১৫% এর বেশী নয়। বাহির মেডিক্যাল যে সমস্ত মক্কেল রোগী যান; তারা নিজ দায়িত্বে যান। মক্কেল রোগীর জন্য রয়েছে মুক্তির পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে বাহির মেডিক্যাল থাকার ব্যবস্থা।
দূর্নীতির আরেক ধাপ হচ্ছে জামিনের জন্য হাসপাতাল প্রতিবেদন আসামীর পক্ষে দেওয়ার আরো একটি ব্যবসা রয়েছে কারা হাসপাতালগুলোতে। অনেক আসামীর পক্ষে আদালত নিবেদন করা হয় যে আসামী শারীরিকভাবে অসুস্থ বা পাগল কারা হাসপাতালে তার যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ নেই বিধায় তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হোক। আদালত আসামী পক্ষের নিবেদনের ভিত্তিতে উক্ত আসামীর শারীরিক অবস্থা জানার জন্য কারা হাসপাতালের প্রতিবেদন চেয়ে পাঠান। প্রতিবেদন পক্ষে যাবে না বিপক্ষে যাবে তা নির্ভর করে কত টাকা দেওয়া হবে তার উপর। বর্তমান সময়ে যদি কোন বন্দিকে গুরুতর সাবস্ত্য করে প্রতিবেদন দিতে হয় সেজন্য ফার্মাাসিষ্ট হামিদকে ২০ হাজার টাকা প্রদান করতে হয়।
সাবেক এক জনপ্রতিনিধি প্রায় এক সপ্তাহ কারা হাসপাতালে ছিলেন। সম্প্রতি তিনিও জামিনে বের হয়ে আসেন। তিনি বলেন, যদি কোন বন্দি আসামীর কারা হাসপাতালে চিকিৎসা করা সম্ভব না হয় তাহলে বাহিরের হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হবে এই প্রতিবেদন দিতে হয় তবে নিদেন পক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা প্রদান করতে হয়। যদি টাকা না দেওয়া হয় তবে প্রকৃত রোগী তাদের সত্যি কারা হাসপাতালে চিকিৎসা করানো কোনভাবেই সম্ভব নয় এই রিপোর্ট না দিয়ে বরং বিপক্ষে রিপোর্ট দেওয়া হয়। এধরনের ঘটনার অনেক নজীর রয়েছে। দরকার হলে মরে যাবে কারাগারে তবুও তার শারীরিক অবস্থা সত্যি শোচনীয় তা সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিবেনা। ডায়াবেটিক্স ডায়েট অনুমতি প্রদান করা হচ্ছে কারা হাসপাতাল দূর্ণীতির আরো একটি অংশ। ডায়াবেটিক্স ডায়েট এর জন্য কার্ড প্রতি ৬’শ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মক্কেল রোগীরা খাটে বসে ফালতুর চৌকস তত্ত্বাবধানে খাচ্ছেন আর প্রকৃত রোগীদের জন্য রয়েছে উচ্ছিটাংশ।
সরকারী ঔষধ বাহিরে বিক্রি কারা হাসপাতালগুলোতে যেন নিত্তনৈমেত্তিক ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। ফার্মাসিষ্ট হামিদ প্রতি সপ্তাহে কারা রক্ষী অর্ডালীর মাধ্যমে ৪/৫ হাজার টাকার দামী ঔষধ ইনজেকশন রিকুইজিশন দেন। সেই মতে ফার্মেসী থেকে ঔষধ নিয়ে যান ডাক্তার অর্ডালী পরবর্তীতে সেই রিকুইজিশন স্লিপে প্রতিস্বাক্ষর করে দেন। এভাবে প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ টাকার ঔষধ ইনজেকশন কারাগরের বাহিরে বিক্রি করা হচ্ছে। এত বেশী দাম দিয়ে নিন্ম মানের ঔষধ কিনার প্রবল মানসিকতা কাজ করে ফার্মাসিষ্টর মাঝে; এর মূল কারণ ঔষধ সরবরাহকারীদের নিকট হতে কমিশন লাভ করা।
কয়েকজন হাজতী জানান, কারা হাসপাতালের সবচেয়ে বড় অনিয়ম হলো রোগী দেখার অনিহা, মারমুখী; ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করা। অধিকাংশ সময় দেখা যে রোগী বন্দিদের সমস্যা সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে ডাক্তার আগ্রহী নন।
এদিকে কারাগার নিয়ে সরকারি নিয়মনীতি থাকলেও জেলার আনোয়ার, ফার্মাসিস্ট হামিদ, কথিত জামাদারসহ অসাধু কারারক্ষীরা মিলে ঘুষ বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত করেছে জেলার একমাত্র কারাগারটিকে। কয়েদীদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে মোবাইলে কিংবা সরাসরি ফার্মাসিস্ট হামিদ সীট বাণিজ্যের দরকষাকষি করেন। সরাসরি টাকাও গ্রহণ করেন। জেলা কারাগারের অরাজকতা, নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা ও মাসিক এবং দৈনিক ঘুষ বাণিজ্যের এমন অভিযোগ উঠলেও উপর মহলের দোহায় দিয়ে চলছে দূর্নীতি। তবে এই সব অনিয়ম আর দুর্নীতি হচ্ছে অনেকটা জেল সুপার সাঈদ হোছনের অগোচরে। এমটাই জানালেন কয়েকজন কয়েদী ও হাজতী।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী কারা পরির্দশক রিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী জানান, জেলা কারাহাসপাতালে সিট বেচা-বিক্রি নতুন কিছু নয়। হাসপাতাল পরির্দশন কালে রোগী নয় এমন সব হাজতীদের সিটে ভর্তি থাকায় এ পর্যন্ত ১৫ জনকে সিট থেকে বের করে ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে।
এসব অপকমের্র নেপথ্যে নায়ক জেলার আনোয়ারের কাছ থেকে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কারাগার কারাগারের নিয়মেই চলছে।
কক্সবাজার জেল সুপার মো. সাঈদ হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবী করেন, এই হাসপাতালটি এখন স্বচ্ছ ভাবে চলছে। দুর্র্নীতি বা অনিয়ম করার কোন সুযোগ এখানে নেই।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।