দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে নির্বাচনী তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দেড় বছর বাকি থাকলেও দলগুলো এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন দলেরই প্রধানগণ ইতোমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তৃণমূল নেতারা দলীয় প্রধানদের নির্দেশনা পেয়ে তারা নির্বাচনের জন্য যে যার মতো করে নির্বাচনী ছক তৈরি করছেন। অনেকে কৌশল গ্রহণেরও পরিকল্পনা করছেন।
আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলীয় এমপিদের নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে তিনি এ কথাও উচ্চারণ করেছেন যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। নির্বাচনী এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা থাকলে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে।
বৈঠকে এমপিদের তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার নির্দেশসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে বৈঠক করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় মাস পরপর জরিপ পর্যালোচনার কথাও বলেন তিনি। এ জরিপে যারা ভালো করবেন, আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের সরকারের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তা প্রচার করতেও নির্দেশ দেন।
দলের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিভাগের উপকারভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন ভিডিও কনফারেন্সে। ইতোমধ্যে তিনি রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করছেন। তাদের কাছে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। সরকার জনগণের উন্নয়নে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়াও এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেনে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এসব অনুষ্ঠানে দেশ থেকে জঙ্গিদের নির্মূল করতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের যেমন ঐক্যবদ্ধ হতে বলছেন, একই সঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেরও বিষদ বর্ণনা দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন জেলা সফরের মাধ্যমে জনসভা করে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্বোধন করছেন এবং অনেক কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী এসব করছেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ইতোপূর্বে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের ভুলভ্রান্তি শোধরাতে কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলের প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য জানান, দলীয় প্রধানের নির্দেশে আমরা নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছি। সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কার্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দলের সিনিয়র কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করারও নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কার্যক্রম তদারকির জন্য আটটি বিভাগীয় টিম গঠন করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশে নেতারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা সফর করছেন। নেতাদের সাংগঠনিক সফর ও কর্মসূচিতে দল গোছানো, তৃণমূলে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব দূর করা এবং সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম জনসমক্ষে তুলে ধরার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তুলে ধরা হচ্ছে।
দলের নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, দলে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী যথা সময়ে নির্বাচন হবে। আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের জন্য সকলকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতারা কাজ করছেন।
বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় সে লক্ষ্যে দলটির অভ্যন্তরে কৌশলগত বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তৃণমূলেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দল পুনর্গঠন করতে ইতোমধ্যে ৫১টি দল গঠন করেছে বিএনপি। এসব দল সারাদেশে কর্মীসভা এবং দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও জোরদার করতে নির্দেশনা দিচ্ছে। জাতীয় রাজনীতি, আগামী নির্বাচন ও সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন নেতারা। একই সঙ্গে ৩০০টি নির্বাচনী আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে তৎপর দলটি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, আগামী নির্বাচন উপলক্ষে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শিগগিরই নির্বাচনকালীন সময়ে ‘সহায়ক সরকার’ নামে একটি রূপরেখার প্রস্তাব তুলে ধরবেন। এ প্রস্তাব যদি সরকার গ্রহণ না করে তাহলে সারাদেশে প্রস্তাবের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা হবে। তারা জানান, এ কৌশল সামনে রেখেই দল গোছানো, সাংগঠনিকভাবে দল শক্তিশালী করা এবং এলাকায় দলের অবস্থান কতটুকু শক্তিশালী তা নিয়ে আলোচনা করতেই ৫১টি দল গঠন করা হয়েছে। এ সফরের মূল টার্গেট আগামী জাতীয় নির্বাচন। এ ইস্যু নিয়ে সংগঠনের অবস্থা জানান দেয়া, তৃণমূলের অবস্থা জানা এবং পরবর্তীতে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়ক হবে।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি সিনিয়র নেতাদের একাধিক বৈঠকে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনার পরই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। সে অনুযায়ী মাঠপর্যায়ের প্রার্থী জরিপ তথা আসনভিত্তিক বিশ্লেষণ দলটির একাধিক পর্যায় থেকে করা হচ্ছে। এছাড়া বিএনপির থিংকট্যাংক বলে পরিচিত ‘গবেষণা সেল’ এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজে হাত দিয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বড় একটি দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। কারণ গত তিনটি নির্বাচনে বিএনপির বেশির ভাগ প্রার্থী রয়ে গেছেন। যাদের বেশির ভাগই চেয়ারপারসনের পরিচিত। এছাড়া দলের গবেষণা সেল এ বিষয়ে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিএনপি অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনে যেতে পারবে। তবে এর জন্য অবশ্যই সহায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে।
জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রস্তুতি
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন জাতীয় পার্টিও প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে দলের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার কাজে মনোনিবেশ করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলা সফরে গিয়ে নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি পার্টির সংসদীয় দলের সভায় দলীয় এমপিদের এলাকায় গিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৫৮টি দল নিয়ে জোট করা নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি অংশ। সম্প্রতি এরশাদ একটি অনুষ্ঠানে বলেন, মামলা দিয়ে আমাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। অতি দ্রুত মামলার ঝামেলা শেষ করে আবারও মাঠে নামব। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। নিবার্চনে ৩০০ আসনে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের একটি জাতীয় পার্টি। দল আরও শক্তিশালী করতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আগামীতে বিএনপি নির্বাচনে না আসলে জাতীয় পার্টি সবকটি আসনে নির্বাচন করবে। সে ক্ষেত্রে আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব, জানান তিনি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।