মিয়ানমারের মংন্ডু রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আতংক থামছে না। সেদেশের সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন নিপীড়ন ও নৃশংস নির্যাতন অসহায় রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি সহায় সম্পদ ত্যাগ করে অনুপ্রবেশ করছে এক কাপড়ে। তারা বলছে, এখানে মরলেও শান্তি পাব। এদিকে উখিয়ার বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে অনাকাংখিত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে উখিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছেন।
সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য ও কুতুপালং বস্তি এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে রীতিমত হতবাক হওয়ার কথা। শনিবার ভোররাতে দুই শিশু সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসা ফাতেমা বেগম(২৫) জানায়, “তার স্বামী বাড়ির পার্শ্বে ধান কাটছিল। এসময় সেনাবাহিনী ও রাখাইন সদস্যের একটি দল তাকে ধরে নিয়ে যায়। আগুন দিয়ে বাড়ীটি পুড়ে ফেলে। কিছু নেওয়ার মত পরিবেশ ছিল না। দু’টি সন্তান কে বুকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। সে বলছে, এখানে মরলেও শান্তি পাব”।
মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের জমিলা খাতুন (৪৫) জানায়, “তারা গত ৪ দিন ধরে সেদেশের সীমান্ত এলাকার খেয়াবনে কিছু না খেয়ে লুকিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। সেখানকার একজন দালালের মাধ্যমে শনিবার ভোর রাতে উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে কুতুপালং বস্তিতে এসেছেন।”
সে আরো জানায়, “তার পাশের বাড়ীটি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে তার বাড়ীটিও পুড়ে যায়। এসময় ছেলে মেয়ে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ৭/৮ দিন অবস্থান করার পর অবশেষে নাফনদী পার হয়ে এপারে চলে আসতে সক্ষম হয়েছি”।
মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের সব হারিয়ে নিঃস্ব মমতাজ বেগম (৪০) জানায়, “সেনা সদস্যরা তাদের গ্রামে লুটপাট চালিয়ে মেয়েদের ইজ্জত লুন্ঠন করছে। ছেলেদের ধরে নিয়ে জবাই করে মারছে। ছোট ছোট ছেলেদের আগুনে নিক্ষেপ করছে। নৃশংস এ বর্বরতার হাত থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে চলে এসেছি। সে দুঃখ করে বলেন, এত সহায় সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আজ এক কাপড়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।”
স্বামী হারা সাজু বেগম(২৫) জানায়, “পুলিশ তার স্বামী ইউনুছ কে ধরে নিয়ে গেছে। পরে শুনেছি তাকে মেরে ফেলে লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শিশু সন্তান ফায়সাল (৫), রাশেদ (৩) ও আনোয়ার (২) এই তিন সন্তানকে নিয়ে কুমিরখালী থেকে অনেক কষ্টে নাফনদীর পাড়ে এসেছি। সেখান থেকে আরো কয়েকজন গ্রামবাসীর সহায়তায় নৌকায় উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভোর রাতে কুতুপালং বস্তিতে পৌঁছতে পেরে মনে করছি ৩ সন্তানকে হায়েনাদের থাবা থেকে রক্ষা করতে পেরেছি।”
পোয়াখালী নয়াপাড়া গ্রামের একরাম (১৫) জানায়, “গভীর রাতে সশস্ত্র সেনাবাহিনী ও সেখানকার পুলিশ গ্রামে আগুন দিলে মা-বাবা- ভাইবোন সহ ৫ জন কোথায় গেছে জানতে পারি নাই।” সে জানায়, “তার গ্রামের আরো কয়েকজনের সাথে কোন রকম নিজেকে রক্ষার জন্য এখানে পালিয়ে এসেছি।”
খেয়ারীপাড়ার আব্দুল হামিদ (২৬) জানায়, “ঘরে আগুন দিয়ে পুড়ে দেওয়ার সময় তার চোখের সামনে বয়োবৃদ্ধ পিতা শফিউল্লাহ (৫৫) মারা যায়। উপান্তর না দেখে বাবার লাশ ফেলে মাকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে পৌঁছতে তাকে দেড় লাখ (কিয়াত) সেখানকার দালালকে দিতে হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান।”
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে.কর্ণেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, যে সমস্ত এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সে সমস্ত ফাঁকা স্থান গুলোতে বিজিবি’র নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, তথাপিয় ফাঁকফোকর দিয়ে আসা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও মানবিক সেবা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
উখিয়ার বৌদ্ধ মন্দির ও রাখাইন পল্লীতে পুলিশি নিরাপত্তাঃ
মিয়ানমারের মংন্ডু রাখাইন পল্লীতে অগ্নি সংযোগ সেখানকার নিরীহ লোকজনের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন নিপীড়ন, খুন, লুটপাটের প্রভাব এদেশের বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে যেন না পড়ে সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। বাড়ানো হয়েছে পুলিশের সংখ্যা। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরোজুল হক টুটুল সম্প্রতি এনিয়ে উখিয়া থানায় বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ ও কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। এসময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এখানকার বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে যেন কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এবং সার্বক্ষণিক পুলিশি নজরদারি জোরদার রাখার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে এখানকার ৩৮টি বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নেয়া হয়েছে কড়া নজরদারি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।