বিশেষ প্রতিবেদকঃ মিয়ানামারে চলমান অরাজকতায় নির্বিচারে খুন হচ্ছেন সাধারণ ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ। ধর্ষিত হচ্ছে যুবতীসহ সুশ্রী নারীরা। এসব পাশবিকতা থেকে বাঁচতে সীমান্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। মিয়ানমারের এসব বর্বরতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রচার পাবার পর সর্বহারা রোহিঙ্গাদের জন্য সোচ্চার হচ্ছেন মানবতাকামী মানুষগুলো। ওপারে বৌদ্ধধর্মালম্বী সেনা ও যুবকদের হাতেই রোহিঙ্গারা নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছেন বলে প্রচার পাবার পর বাংলাদেশে বসবাসকারি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মিয়ানমার পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কমেন্টস এসেছে।
কিন্তু একটা দেশে নানা ধর্মালম্বীর অবস্থান থাকে এবং একই ধর্মের অনুসারী হলেও একজনের অপরাধে অপরজনকে দোষারোপ করা মোটেও সমীচিন নয়। এসব কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের নাগরিক বৌদ্ধধর্মালম্বীদের উপসনালয়সহ পাড়ার নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রশাসন। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার ৭ উপজেলার প্রায় ১৩৩টি বৌদ্ধমন্দিরের নিরাপত্তায় বিহার সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরমাঝে গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৫৩টি বৌদ্ধ বিহারে বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেউ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে সেজন্য উখিয়ার প্রতিটি বিহারে পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান উখিয়া উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক প্লাবন বড়ুয়া।
পুলিশ প্রশাসন সূত্র জানায়, সারাদেশের ন্যায় উখিয়ায়ও প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে নিরাপত্তা জোরদার ও বিহার সুরক্ষা কমিটি গঠন করার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ দপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়। এর আলোকে উখিয়ার ৩৮ ও টেকনাফের ১৫টিসহ পুরো জেলার ১৩৩টি বৌদ্ধ বিহারের অধিকাংশ বিহারের সুরক্ষা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
উখিয়া ভিক্ষু সমিতির সাধারণ সম্পাদক, পুরাতন রুমখা ত্রিরত্ন বৌদ্ধ বিহারের পরিচালক জ্যোতিঃপ্রিয় ভিক্ষু জানান, ইতোমধ্যে উখিয়ায় বিহারে নিরাপত্তা জোরদার ও সুরক্ষা কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। পুরাতন রুমখা ত্রিরত্ন বিহারেও ২১ জনের একটি সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও রাতে পাহারা দেয়ার জন্য বড়ুয়া ছেলেদের নিয়ে ১৬ জনের একটি কমিটি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তাদের পাশাপাশি প্রতি রাতে পুলিশের বাড়তি টহলও আসে বলে উল্লেখ করেন এ ভিক্ষু।
উখিয়া পাতাবাড়ি কেন্দ্রীয় আনন্দ ভবন বৌদ্ধ বিহারের পরিচালক প্রজ্ঞাবোধি থের বলেন, তার বিহারেও ১২ জনের একটি সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরপরও ২০১২ সালের অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে রাত এলেই অজানা শংকায় থাকেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য তিনি সন্ধ্যার পর বিহার থেকে পারত পক্ষে বের হন না। যতক্ষণ জেগে থাকেন চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন বলে জানান তিনি।
দীপাংক্ষুর বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট পুলিশ দপ্তরের নির্দেশে বিহারের নিরাপত্তায় সব ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে ১৫ জনের সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে উপদেষ্টা হিসেবে আছেন ৩নং হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম, বিমল জ্যোতি মহাথের, এম মনজুর আলম মেম্বার। সভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে সাবেক মেম্বার মোঃ ইসলাম এবং সাধারন সম্পাদক বাবুল বড়ুয়া (সওদাগর)। সদস্যরা হলেন, উখিয়া উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহজাহান সাজু, হলদিয়ার ছাত্রদল সভাপতি এস এম লিকসন, বিহার পরিচালনা কমিটির সম্পাদক সুদত্ত বড়ুয়া চামু। এভাবে প্রতিটি বিহারেই নিরাপত্তা কমিটি গঠন করায় ভ্রতৃত্যবোধের মাধ্যমে আমরা শান্তিতে রয়েছে বৌদ্ধ সমাজ।
মরিচ্যা বেনুবন বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির অর্থ সম্পাদক সন্তুষ বড়ুয়া জানান, তাদের বিহারেও ৩নং হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম, ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি মো. ইসলাম ও ইউপি সদস্য এম মনজুর আলমকে উপদেষ্টা রেখে ১৫ জনের সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে আ’লীগ নেতা নজির আহমদ সভাপতি ও ভদ্দিয়বোধি ভিক্ষুকে সাধারন সম্পাদক করা হয়।
রামু উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক ও বৌদ্ধ নেতা নীতিশ বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। এরপরও ২০১২ সালের একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা শত শত বছরের বিশ্বাসে আছড় লাগিয়েছিল। কিন্তু মানবতার পূজারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাসের সে ছিড় ধরা ক্ষত সেরে তুলেছেন। প্রতিবেশী দেশে চলমান অরাজকতায় আমরাও ব্যতিত। এ ঘটনায় আমরা আনুষ্ঠানিক নিন্দা জানিয়ে আসছি। যতটুকু সম্ভব নিপীড়িত মানবতার পাশে দাঁড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। এরপরও কিছু নির্বোধের খেয়ালিপনার ভয় থাকে। তাই প্রশাসন সব ধর্মের লোকজন নিয়ে জেলা ব্যাপী বিহার সুরক্ষা কমিটি গঠন করেছে। এতেই শেষ নয়। প্রতিরাতে সব থানার পরিদর্শকগণ পুলিশ বিশেষ টহলদল দিয়ে জেলার শতাধিক বিহারে নিরাপত্তা বলয় তৈরী করছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মূখপাত্র আফরোজুল হক টুটুল বলেন, কোন দেশে কি হচ্ছে এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের লক্ষ্য এবং চাওয়া হলো আমাদের দেশের সব ধর্মের নাগরিক দেশের আইন মেনে একাত্ম হয়ে বাস করবো। ধর্মের চেয়ে একে অপরকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের সুবিধা-অসুবিধায় দাঁড়ানোটাই বড় কর্তৃব্য। পুলিশের নির্দেশনায় বিহার সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা শুধু নয় সব নাগরিকের দায়িত্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা এবং সম্মান অক্ষুন্ন রাখা। সবার সহযোগিতায় দেশে শান্তির ধারা অব্যহত থাকবে এবং এটায় আমাদের সবার চাওয়া।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।