প্রতিদিন পত্রিকাটির সাড়ে ৫ লাখ কপি ছাপা হয়, পাঠকসংখ্যা ৫৫ লাখ ছাড়িয়ে। ফেসবুকে তাদের অনুসারী এক কোটিরও বেশি। বিশ্বের এক নম্বর বাংলাদেশি ওয়েবপোর্টাল তাদের অনলাইন ভার্সন। প্রায় ২০০টি দেশ থেকে পড়া হয় তাদের অনলাইন। পত্রিকাটির নাম প্রথম আলো।
সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় অনলাইন মিডিয়া বা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষ সব খবরা খবর আগেভাগেই জেনে গেলেও সকালে চা অথবা নাশতার টেবিলে কিংবা বাসে বা গাড়িতে অফিসের পথে মানুষের হাতে থাকে ওই দিনের দৈনিক সংবাদপত্র। আর সেই দৈনিকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জায়গা করে আছে যে পত্রিকা সেটি মতিউর রহমান সম্পাদিত প্রথম আলো।
দৈনিকটি শুক্রবার (৪ নভেম্বর) আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিচ্ছে। শুরুর পর শীর্ষে পৌঁছাতে শুধু কয়েক মাস লেগেছে, প্রথম আলো এরপর থেকে গত দেড় যুগে দেশের দৈনিকগুলোর মধ্যে সবসময় শীর্ষেই ছিল।
কীভাবে তারা ধরে রাখতে পেরেছে এ অবস্থান? গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষকরা কী বলছেন? প্রথম আলো’র ‘ম্যাজিক’ নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইন কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে।
তারা যেটা বলেছেন তার মূল কথা: কিছু ভুলচুক সবারই থাকতে পারে, প্রথম আলোও তার ঊর্ধ্বে নয়; তারপরও এভাবে নিজেদের অটল অবস্থান ধরে রাখতে পারার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সাংবাদিকতার চর্চা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মফিজুর রহমানের মতে , ‘ সংবাদপত্রটিতে ক্ষমতাশালীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে আসার সাহসী প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় । প্রথম আলো প্রথম থেকেই নিজেদের স্বকীয়তা উপস্থাপন করে আসছে। আসলে পাঠক যা চায় তার যোগান দেয়ার মাধ্যমেই প্রথম আলো আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে।
পত্রিকাটিতে সংবাদের পাশাপাশি দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের কলামসহ নানা আঙ্গিকের লেখা পাঠকে আকর্ষণ করে। সংবাদ উপস্থাপন, বিষয়বস্তু নির্বাচনে আছে রুচির পরিচয়। নান্দনিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,ছাত্রসহ সচেতন পাঠক মহলে প্রথম আলো’র গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে একটা শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। শুধু তাই নয় একটি শীর্ষ সংবাদপত্র হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং শিশু-তরুণদের অংশগ্রহণমূলক প্ল্যাটফর্ম বা ভরসার জায়গাটিও হয়ে উঠেছে প্রথম আলো’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের চেয়্যারম্যান উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল মনে করেন, প্রথম আলোর এগিয়ে যাওয়ার এবং সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারার অন্যতম কারণ হলো তাদের রিপোর্টের বিন্যাস যেমন খুব ভালো, তেমনই যেসব সোর্স থেকে ওইসব রিপোর্ট করা হয় সেগুলোও খুব ভালো।
‘পাঠকের ভালো লাগা ও মন্দ লাগার জায়গাটাকেও খুব গুরুত্ব সহকারে দেখে তারা। আর সেটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ,’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেমন খেলার পাতা আগে মাঝের দিকে ছিল, এখন শেষের দিকে এসেছে। পাতাটা বড়ও হয়েছে। পাঠক কী চায় সেটা মাথায় রাখলেই একটি পত্রিকা বড় হতে পারে।
প্রথম আলো’র সাফল্যের কারণ বলতে গিয়ে তিনি এটাও উল্লেখ করেন, দেশের সেরা সেরা সাংবাদিকদের বেছে নেয় প্রথম আলো। সময়ের সঙ্গে এসেছে প্রথম আলোর রঙ ও লেখার ধরনে পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে খবর নির্বাচনেও।
সামাজিক কার্যক্রমে প্রথম আলো’র সরব উপস্থিতিরও প্রশংসা করেন উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল। ‘তারা এক্ষেত্রেও সক্রিয়– সেটা মাদকবিরোধী আন্দোলনই হোক বা নারী ও শিশুদের নিয়ে কথা বলাই হোক।’
এসব বিষয়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়্যারম্যান প্রদীপ কুমার পাণ্ডে যোগ করেন প্রথম আলোর আরো কিছু কর্মকাণ্ডের কথা। যেমন: প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াড করে, সেটা ছেলেমেয়েদের গণিতে আগ্রহী করে তোলে। শিশুদের একটা জায়গাও ওখানে আছে।
‘প্রথম আলো কখনোই এক শ্রেণীর পাঠকের জন্য নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরং সবার জন্যই তারা নিজেদের সাজিয়েছে ভিন্নভিন্ন ভাবে। ‘তাছাড়া প্রথম আলোর কাছে যেভাবে কোন খবরের গভীর বিশ্লেষণ পাই সেটা তো আর অন্য কোথাও মেলে না। সেসব মিলিয়েই নির্ভরতার জায়গা অর্জন করেছে প্রথম আলো।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি আর রাজী প্রথম আলোর সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানালেন খবর নিয়ে তাদের ভেতরের চর্চার কথা।
তিনি বলেন: প্রথম আলো সবার উপরই এক ধরনের তদারকি বজায় রাখে। কোন কিছুই নিজেরা নিশ্চিত না হয়ে ছাপায় না প্রথম আলো। সারাদেশের মানুষের কাছেই তাদের সেই সুনাম ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে তারা।
প্রথম আলোর ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই সমানভাবে সচেতন বলেই মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়্যারম্যান হেলেনা ফেরদৌসী।
তিনি বলেন: প্রথম আলোর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এমন কোন রিপোর্ট তারা সচরাচর করে না। অন্য কেউ এতদিনেও তাদের এই অবস্থানটা অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম আলোর কাছে প্রত্যাশা
সাংবাদিকতার শিক্ষকরা প্রথম আলো-কে দেশের সংবাদপত্র জগতে সবার সেরার স্বীকৃতি দিলেও তারা একথাও বলেছেন, দৈনিকটি যে একেবারে ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে এমন নয়। ভুলচুক তাদেরও হয়।
হেলেনা ফেরদৌসী বলেন, কিছু ঘটনা আমরা চোখের সামনে দেখি একরকম, কিন্তু পত্রিকার পাতায় আসে ভিন্নভাবে। পক্ষপাততো সবার মধ্যেই থাকে। কিন্তু সব পাঠকই তাদের পাঠক। তাই সবার কথা তাদের মনে রাখতে হবে। পাশাপাশি কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ছাপ যেন সংবাদে না পড়ে সেটাই পাঠক হিসেবে চাওয়া।
হেলেনা ফেরদৌসীর পাশাপাশি আর রাজীও চান পত্রিকাটির রিপোর্টিং আরো উন্নত হোক। রিপোর্টিং সেকশনটিকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলার সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মুখ আরো বেশি বেশি দেখতে চান তিনি।
প্রদীপ কুমার পাণ্ডে অবশ্য মনে করেন, নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে বেশি বেশি রিপোর্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এরকম হলে মনে হয় যেন নিজেদের কোন এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে প্রথম আলো। সেসব জায়গায় একটু ম্যাচিউরিটি দেখাতে পারে তারা।
একই কথা বলছিলেন উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়গুলোতে দেখা যায় কারো ছবি খুব বড় করে ছাপা হয় আবার অন্যজনেরটা ছোট করে। সেখানে স্বভাবতই পক্ষপাত বোঝা যায়। কিন্তু, সবক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা চায় পাঠক।
পাশাপাশি প্রথম আলো খুবই জনপ্রিয় একটি পত্রিকা বলে তাতে বিজ্ঞাপনের চাপও বেশি থাকে বলে মনে করেন তিনি। ‘বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে দেখা যায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিউজ বাদ পড়ে গেছে। এদিকটায় বাড়তি নজর দরকার। প্রথম আলো ইতিবাচক খবর প্রকাশেও আরো বেশি জোর দিতে পারে।
প্রথম আলোর দেড় যুগ পূর্তিতে এর প্রশংসা আর কিছু সমালোচনার পরও সাংবাদিকতার শিক্ষকরা বলছেন, প্রথম আলো তার পাঠককে বুভুক্ষ করে তোলে। সেজন্য পাঠকও প্রতিটি দিন প্রথম আলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সেই জায়গায় তারা আরো দীর্ঘ সময় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে ওই শিক্ষক-পাঠক-সমালোচকদের প্রত্যাশা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।