বিশেষ প্রতিবেদকঃ কক্সবাজারের মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে চলছে শীব চতুদর্শী পূজা। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৪৫ মিনিট থেকে পূজার লগ্ন শুরু হয়ে শেষ হয়েছে বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাত ১টায়। আর এ পূজাকে উপলক্ষ্য করে সপ্তাহব্যাপী চলছে ঐতিহ্যবাহি আদিনাথ মেলা। বুধবার সকালে মেলা প্রাঙ্গণে বেলুন ব্যবসায়ী গণেশ বনিক (৪৬) ও মমতা রাণী বণিক (৩৮) নামে এক দম্পতি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারাযান। আহতহন আরো বেশ কয়েকজন। এ ঘটনার পর এলাকায় থম থমে অবস্থা বিরাজ করছিল।
এরই মাঝে বিকেলে থানা পুলিশের সদস্য কনস্টেবল আফতাব উদ্দিন (নং-৫২৯)‘র একটি মানবিক ঘটনা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে ছবিটি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে আফতাব এক বৃদ্ধানারীকে পাঁজাকোলা করে বেয়ে উঠছেন মন্দিরের শতাধিক সিঁড়ি। আর তা অবলোকন করছেন সিঁড়ির দু’পাশে দাঁড়ানো পুজারী ও দর্শনার্থীরা। বৃদ্ধাকে মন্দিরের একেবারে জিরো পয়েন্টে এনে পুজা ও মনভরে প্রার্থনা করবার সুযোগ করে দিয়ে পুনরায় কোলে নিয়ে আগের জায়গায় রেখেদেন পুলিশ সদস্যটি।
এ ঘটনার রহস্য খোঁজতে গিয়ে জানাগেছে এক অভিনব কাহিনী। যা ধর্মের চেয়ে মানবিকতাকে উঁচুতে তুলেছে। কোলে থাকা বৃদ্ধার হাতের কারণে পুলিশ সদস্যের নেমপ্লেটটি দেখা যাচ্ছিল না। তাই অনেকে মনে করেছিলেন সনাতনী যুবকটি তার বয়োবৃদ্ধ আত্মীয়াকে জীবনের শেষ বয়সে শিবপূজা দিতে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু যখন জানাগেল পুলিশ সদস্যটি মুসলমান তখন চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। এটা কিভাবে হলো? কেন একজন মুসলমান সনাতনী একবৃদ্ধাকে এভাবে পূজা করতে সহযোগিতা করলেন..? এরকম নানা ধরণের আলোচনা। এতে পুলিশের ভাল-মন্দ নিয়ে নানাজন নানা অভিজ্ঞতার কথা বলে আলোচনাটি সরব রেখেছে।
কিন্তু কি এমন কারণে আফতাব এমনটি করলেন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি নিজেই। আফতাব বলেন, আমরা আদিনাথ মন্দির এলাকায় নিরপত্তার ডিউটি করছিলাম। আদিনাথ মন্দিরের নিচে বসেছে শতাধিক দোকান-পাটের মেলা যেখানে মানুষে গিজগিজ করছিল। আর মন্দিরে উঠতে পার হতে হয় শতাধিক সিঁড়ি। নিরপাত্তার স্বার্থে সিঁিড়ির মাঝখান খালি রেথে দুপাশ দিয়ে পুজারী উঠার ব্যবস্থা করা হয়। সেভাবেই সময় মতো পুজা দিতে যে যার মতো ব্যস্ত। সে ব্যস্ততায় দেখলাম লাইনে দাঁড়াতে অক্ষম এক বৃদ্ধা সিঁড়ির একপাশে বসে কাতর স্বরে সবার কাছে আকুতি রেখে চলছে, তাকে যেনো মূল মন্দিরে পৌঁছাতে সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু কেউ বিষয়টি গ্রাহ্য করছেনা। নতুন কাপড়ে কঙ্কালসার দেহের নারীটিকে অবলোকন করে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। নিজের অজান্তেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। মূল মন্দিরের সামনে তার পছন্দমতো জায়গায় বসালাম এবং পূজা ও প্রার্থনা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আবার সেই জায়গায় এনে রাখলাম।
আপনি মুসলমান হয়ে একজন সনাতনী নারীকে পূজা করতে সহযোগিতা দিলেন এতে কোন সংকোচ কাজ করেনি ? এমন প্রশ্নে আফতাব বলেন, যখন বৃদ্ধাকে কোলে নিলাম তখন আমার মাথায় ধর্মানুভূতি কাজ করেনি। মনে হচ্ছিল আমি আমার মাকে তার আবদার পুরণে সহযোগিতা করছি। কোলে মানুষ নিয়ে শতাধিক সিঁড়ি উঠা কষ্টকর; তাই চারপাশে তাকানো হয়নি আমার। কে কি করছে, কে ছবি তুলছে এসব খেয়ালে আসেনি। যখন তাকে পূর্বের জায়গায় নিরাপদে পৌছাতে পারলাম তখন নিজেকে বেশ প্রফুল্ল মনে হচ্ছিল। তখন দেখি বৃদ্ধাটি নিদিষ্ট লগ্নের ভেতর পুজা দিতে পেরে নানা ধরণের আশির্বাদ করছে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিরাপত্তার কাজে লেগে যাওয়ায় বৃদ্ধাটির পরিচয়ও জানা হয়নি মহেশখালী থানা কনস্টেবল ও নোয়াখালীর কবিরহাট এলাকার মৃত বেলায়েত হোসেনের ছেলে মো. আফতাব উদ্দিনের। বৃদ্ধ নারীটি তার জন্য অনেক দোয়া-আশীর্বাদ করেছে, এটিই তার বড়ো পাওনা বলে জানান এই পুলিশ সদস্য।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক বিয়ষক সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত বলেন, কিছু ঘটনা এমনই হয়। যা দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় আমরা অসাম্প্রদায়িক দেশের অধিবাসী। পুলিশ সদস্য আফতাবের ঘটনাটি ধর্মকে ছাপিয়ে মানবিকতার জয়গান এনে দিয়েছে। আমরা এমনই বাংলাদেশ অব্যাহত থাকুক এমনটি কামনা করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই অমর কথা ধর্ম যার যার রাষ্ট্র এবং উৎসব সবার। আমরা মানবিক মানুষ হিসেবে আফতাবকে স্যালাউট জানাচ্ছি।
মহেশখালী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সবার নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে পরিবার পরিজন থেকে পুলিশ সদস্যদের বছরের সিংহভাগ সময় দূরেই থাকতে হয়। এরপরও পান থেকে চুন কষলেই কত কটুকথা, সমালোচনায় ভরিয়ে দেয়া হয় পুলিশকে। কিন্তু আফতাবদের মতো অসংখ্য ভাল কাজ পুলিশ নিত্য করছে। কিছু নজরে আসে আর কিছু আড়ালে থেকে যায়। নজরে আসা আফতাবের মানবিক ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মতো আমাদেরও পুলকিত করছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।