কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে ফিরতে চান না অধিকাংশ রোহিঙ্গা। তারা বলছেন, ‘নাগরিকত্ব না থাকায় আমরা শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অন্ধ’ করে রাখা হয়েছে যুগের পর যুগ। আমাদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিছু মাদ্রাসা ছিল। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে তা বন্ধ রয়েছে। আমাদের যেতে দেয়া হয় না শহরে কিংবা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে। চাষবাস আর পশু পালনই আমাদের একমাত্র জীবিকা। অবস্থা এমন যে, আমাদের অনেকে যন্ত্রচালিত যানবাহন বা গাড়ি দেখেনি। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অনেককে যন্ত্রচালিত গাড়ি দেখে ভয় পেতে দেখা গেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কী জিনিস রোহিঙ্গারা জানে না। বিয়ের বয়স নিয়েও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ১০-১২ বছরের মেয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। কিশোরীরা মা হচ্ছে প্রতিবছরই।’
১২-২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের পথে পথে ঘুরে, বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে বিস্ময়কর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কতিপয় রোহিঙ্গা মুসলিম ‘বিদ্রোহীর’ সন্ত্রাসের অজুহাতে রাখাইন রাজ্যের সাধারণ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারের সেনারা নিদারুণ জুলুম চালালেও বাস্তবতা হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গারা এসবের কিছুই জানেন না। মিয়ানমার বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি- আরসা’-কে (স্থানীয়ভাবে যাদের আল ইয়াকিন বা আলেকিন বলা হয়) চিহ্নিত করলেও সেই আরসা সম্পর্কেও ন্যূনতম ধারণা নেই সাধারণ রোহিঙ্গাদের। ‘স্বাধীনতা’ বা ‘বিদ্রোহ’ কী জিনিস সেটাও বোঝে না অনেকে। কারণ চাষবাস করে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে জীবন ধারণ করতেই যারা গলদঘর্ম; সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ করার সময় কোথায় তাদের!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৪২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চলে আসছে। ১৯৭৮, ১৯৯১ ও ১৯৯৮ সালে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এ ছাড়া বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অধিকারবঞ্চিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল। গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ চেকপোস্টে ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার অজুহাত তুলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা ভয়াবহ অত্যাচার শুরু করে। ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার পাশাপাশি চলে হত্যা ও ধর্ষণ। এ কারণে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। এই এক মাসেই প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। অভিযানের এক মাসে মিয়ানমার সেনারা মংডুর বুচিদং, রাচিদংসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২১৪টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও নির্মম নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে।
তারা জানান, মিয়ানমার সেনা ও উগ্র বৌদ্ধদের এমন ভয়াবহ নির্মমতার পর আর সেখানে ফিরে যাওয়াটা কোনোভাবেই নিরাপদ হবে না। যদি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান করে ফিরিয়ে নেয়, শিক্ষা, চিকিৎসা বাসস্থানসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিকভাবে দেয় তবেই তারা সে দেশে ফিরে যাবে। নয়তো বাংলাদেশেই তারা মরবে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি দু’দিন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করেছেন। সোমবার ঢাকায় এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার জন্য মিয়ানমার দায়ী। তাদেরই এ সমস্যা সমাধান করতে হবে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হবে। শুধু ফিরিয়ে নিলেই হবে না রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের বুচিদং তমবাজার এলাকার বাসিন্দা হাফেজ ইদ্রিস জানান, মিয়ানমারের স্থানীয় এক মসজিদে চাকরি করতেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে সব ওলটপালট হয়ে যায় তার। সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের কোনো অপরাধ ছিল না। নিজের জন্মভূমি হলেও নাগরিক মর্যাদা না পেলে তিনি আর সেখানে ফিরতে চান না। মিয়ানমারের মংডু জেলার বলিবাজার থেকে আসা শিব্বির বলেন, ‘আমার চোখের সামনে আমার বড় ছেলেকে মেরে ফেলেছে সেনারা। ছেলেকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের গুলির মুখে আর টিকতে পারিনি। মিলিটারির সঙ্গে ‘মগরা’ এসে যাকে সামনে পেয়েছে তার গলা কেটে দিয়েছে। আমার ছেলেরও গলা কেটেছে। তাই এক কাপড়ে চলে এসেছি। ছেলেটারে দাফনও করতে পারিনি। আর কোনোদিন ফিরতে পারব কি-না জানি না। ফেরার ইচ্ছাও নেই।
শিব্বির আরও বলেন, ‘রাখাইনরা সব সুযোগ-সুবিধা পায় সেখানে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমান হয়ে জন্মানোটাই যেন অপরাধ। লেখাপড়ার সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ যা আছে শহরে। রাখাইনে যে কটি মাদ্রাসা ছিল তাও ২০১২ সাল থেকে বন্ধ। অশিক্ষিত হয়েই বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা। নাগরিকত্ব না দিলে, লেখাপড়ার সুযোগ না দিলে রাখাইনে গিয়ে কী লাভ হবে?’
মিয়ানমারের বুচিদং তমবাজার এলাকার মৌলভী আবু শামা জানান, স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন তিনি। জন্মভূমিতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবার নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, বাংলাদেশে পালিয়ে না এসে আর পারা যায়নি। তিনি বলেন, ‘জন্মভূমিতে ফিরতে চাই; তবে পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে ফিরতে পারলেই ফিরব। এর আগে নয়।’ একই এলাকার আরেক বয়োবৃদ্ধ কামাল মিয়া বলেন, নির্যাতনের মুখে ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালেও তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ ঠিক হওয়ায় পর আবারও ফিরে গেছেন। আবারও ফিরতে চান তিনি। রাখাইনে বৌদ্ধ বা মগরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় সেসব সুযোগ-সুবিধা পেলেই ফিরে যাবেন।
সূত্র- যুগান্তর
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।