একাদশ নির্বাচনের আর বাকি বছর দেড়েক। শেষ ছয় মাসে চাইলেও বেশি কিছু করার সুযোগ নেই। তাই আগামী এক বছরের মধ্যেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোটারের মন জোগাতে অঢেল টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরে সারা দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পেছনে সরকার খরচ করবে এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
আগামী নির্বাচনের আগে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং নতুন অর্থবছরে নতুন নতুন কিছু প্রকল্প নিয়ে ভোটারদের সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগ দেখিয়ে আশ্বস্ত করতেই এডিপিতে এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। নতুন বছরের এডিপি অনুমোদনের জন্য আজ রবিবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় উত্থাপন করা হচ্ছে; যেখানে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধান অনুসারে আগামী বছরের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী অর্থবছরের মধ্যে অর্থাৎ আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যেই সরকার সারা দেশে এডিপিতে বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ করে সর্বস্তরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০১৮ সালের ১ জুলাই যে আরেকটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ পাবে সরকার তা বাস্তবায়নের সুযোগ না থাকায় ওই অর্থবছরের জন্য কোনো ধরনের কাজ ফেলে রাখতে রাজি নন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
আসছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে সরকারদলীয় নেতাদের খুশি রাখার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নের নামে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে হাত খুলে। বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তার নামেও আলাদাভাবে টাকা রাখা হচ্ছে এডিপিতে। যাতে তাত্ক্ষণিক কারো টাকার প্রয়োজন হলে সেখান থেকে দেওয়া যেতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই এডিপির আকার বাড়ছে। কিন্তু সে হারে প্রকল্পের কাজে গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়নি। শুধু প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। এডিপির আকারও বাড়বে। কিন্তু কাজের মান বাড়বে না। আগামী অর্থবছর নির্বাচনী বছর হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বাড়তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। ছোট ছোট প্রকল্পে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা কাজ পাবে। অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রকল্পের কাজের গুণগত মান আরো খারাপ হতে পারে। জনগণের করের টাকা খরচে স্বচ্ছতা ও প্রকল্পের কাজে গুণগত মান নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, আসছে অর্থবছরের এডিপিতে যে এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে ৯৬ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। বাকি ৫৭ হাজার কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ থেকে পাওয়ার আশা করছে সরকার। টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার বাড়ছে ৪২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। চলতি বছরের এডিপিতে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, আগামী বাজেট হবে উজ্জীবিত বাজেট। সব কাজ শেষ করার চেষ্টা থাকবে সরকারের। সাধারণ মানুষের সামনে উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান করার জন্য আসছে বাজেটে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ থাকছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় উত্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতে দেখা গেছে, আসছে অর্থবছরের এডিপিতে সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় বড় প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে আগামী বাজেটে রাখা হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়ার অর্থায়নে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আসছে বছরে সবচেয়ে বেশি টাকা রাখা হচ্ছে, ১০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নে রাখা হচ্ছে দুই হাজার ২২০ কোটি টাকা। রাজধানীবাসীর সামনে মেট্রো রেলের কাজ দৃশ্যমান করার জন্য আসছে বাজেটে তিন হাজার ৪২৫ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে রেল লিংক প্রকল্পে থাকছে সাত হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নের জন্য আসছে বাজেটে পাচ্ছেন দুই হাজার কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে নেওয়া একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার মতো। এর বাইরে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত চার লেন সড়কের জন্য থাকছে তিন হাজার কোটি টাকা।
কমিশন সূত্র বলছে, আসছে বাজেটে সবচেয়ে বেশি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন খাত। এই খাতে ৪১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে, যা মোট বরাদ্দের ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে বিদ্যুৎ খাতে ১৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১২ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে আছে শিক্ষা খাত, ১৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা; যা মোট বরাদ্দের ১১ শতাংশ। এরপর আছে যথাক্রমে ভৌত পরিকল্পনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এদিকে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত উন্নয়ন সহায়তার নামে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের কাজ দিতে বাড়তি টাকা রাখা হচ্ছে এডিপিতে। তাতে দেখা গেছে, আসছে বাজেটে সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন সহায়তা বাবদ ৩৫০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া পৌরসভা উন্নয়নে ৪৪০ কোটি টাকা, জেলা পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি টাকা, উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন সহায়তা বাবদ ১০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তার নামে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। নতুন এডিপি বই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আসছে বাজেটে প্রকল্প থাকছে এক হাজার ৩১৫টি। আগামী বাজেটে ৯টি প্রকল্প বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আজ এনইসি সভায় তোলার কথা রয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।