পানিতে ভাসছে চট্টগ্রাম মহানগরী। গত ১৫ দিন ধরে নগরীর জীবনযাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মাঝে দুই এক দিন ছাড়া বাদ বাকি দিনগুলোতে নগরীর ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত ছিল। নগরীর সেই পতেঙ্গা থেকে শুরু করে কালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটারের নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চল প্রায়শই জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এই ব্যাপক এলাকার মধ্যে যেমন রয়েছে আবাসিক এলাকা। একই সঙ্গে রয়েছে বাণিজ্য ও শিল্পাঞ্চল।
চট্টগ্রাম মহানগরী টিলা, সমতল, নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় অতিবর্ষণে সহজেই পানি নেমে পড়ার কথা। আগে প্রবল বর্ষণে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলেও কিছু সময় পর তা নেমে যেত। কিন্তু বর্তমানে উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কয়েকটি এলাকায় পানি যেন এক প্রকার স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিনদিন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে উপচে পড়া পানি নগরীতে প্রবেশ করে এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে তার চেয়ে কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমসমূহ ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরেও প্রস্তুতকৃত ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়ন না হওয়া এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এরকম হচ্ছে। নগরীর অনেক খাল ও উন্মুক্ত জলাধার সম্পূর্ণ বা আংশিক বিলীন হয়ে যাওয়ায় পানির প্রাকৃতিক রিজার্ভার ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত নদী খাল দখল ও ভরাট করা হচ্ছে। নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলী, ষোলশহর ২নং গেইট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, বৃহত্তর বাকলিয়া, চকবাজার, বাণিজ্য প্রধান খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইসহ ব্যাপক এলাকা গত কয়েকদিন ধরে জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে।
অতিবর্ষণের ফলে অনেক নতুন এলাকায়ও জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে আবাসিক এলাকার লোকজন বুক অবদি পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছেন। বাণিজ্যিক এলাকার মালামাল পানিতে ডুবে যাচ্ছে। মূল সড়কসমূহে নৌকা চলার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পবিত্র রমজান মাসে মানুষের জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। অনেক এলাকার লোকজন সেহরি পর্যন্ত খেতে পারেনি। জলাবদ্ধতার কারণে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে। নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শুধু নগরীর আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকা কয়েক দিনের জলাবদ্ধতায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক মহেষখাল বাঁধে ভাসছে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকা। মূল সড়কের উপর দিয়ে নৌকায় পারাপার করা হচ্ছে লোকজনকে। অথচ নির্বিকার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। জনগণের ধিক্কার সইতে হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণকে। এক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগও যেন লোক দেখানো।
২০১৫ সালে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মহেষখালের ওপর বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি বাঁধ নির্মাণ করে। মহেষখালের বন্দর অডিটোরিয়াম এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ওই বাঁধের ফলে নগরীর দক্ষিণ পশ্চিম আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকাসহ বিস্তীর্ণ অংশ প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে। গত কয়েকদিনের ন্যায় গতকাল সোমবারও আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ আগ্রাবাদের এ বিরাট অংশের লোকজনকে জোয়ারের পানিসহ অতিবৃষ্টির প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য মহেষখালের ওপর বাঁধটি তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা হয়। বাঁধের কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় বাঁধের উভয় অংশের লোকজন সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। নগরীর ৩৬, ৩৭, ৩৮, ২৬, ২৭, ২৪ ও ১১নং ওয়ার্ডের অংশ বিশেষের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহেষখালটির বেশির ভাগই দুই পাড় এবং আবর্জনার কারণে ভরাট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, খালের পাশে অনেক উন্মুক্ত জলাধারে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। খাল উপচে পড়া পানি তাই বাসা বাড়ি এবং বিভিন্ন অলি-গলিতে ঢুকে পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্তমান মহেষখাল যেভাবে প্রবাহমান পূর্বে তা ছিল না। দীর্ঘকাল ধরে মহেষখালের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য কোনো ড্রেজিং না করায় ধীরে ধীরে অনেক স্থানে খালের মূল নকশা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আবার বাঁধ নির্মাণের ফলে ওপরের অংশ নিত্যদিনের জোয়ার-ভাটায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ওপরের অংশে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা জমে ময়লার স্তূপে পরিণত হয়েছে। পূর্বে জোয়ার-ভাটার কারণে ভাটার সময় কিছু ময়লা-আবর্জনা নদীতে চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল। ওপরের অংশে ময়লা-আবর্জনার কারণে দুর্গন্ধসহ মশা-মাছির ব্রিডিং এলাকায় পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, খালের কর্ণফুলী নদীর মুখ থেকে ওপরের পুরো অংশে ব্যাপক খনন করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে খাল পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তা ছাড়া পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট স্থানে বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা এবং বৃষ্টির সময় পানির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বাঁধের ভেতর আবর্জনা অপসারণের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এটি জোরদার করা না হলে তা মুখ থুবড়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
কয়েক মাস পূর্বেই বন্দর উপদেষ্টা কমিটি ও সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয় সভায় বাঁধ অপসারণ করে পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকরের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।