বর্তমানে আমাদের গড় আয়ু ৭১.৬ বছর। অন্যদিকে কিছু অসাধারণ জীব সময়কে পেছনে ফেলে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম পার করে চলেছে।
লক্ষ বছর পুরোনো স্পেনের সমুদ্রতলের ঘাস, ১৮৪ বছর বয়সী কচ্ছপ, ৮০ হাজার বছরের পুরোনো প্যান্ডো গাছ, সত্যিই প্রাচীন জীব হিসেবে ধরা যায়।
প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নানা প্রাচীনতম উদ্ভিদ ও প্রাণী হাজার হাজার দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে আসছে। দর্শনার্থী ছাড়াও বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানীদের জানার আগ্রহও বাড়িয়েছে এই জীবগুলো। তাদের অবিশ্বাস্য আয়ুর পেছনে আসলে কি কাজ করতে পারে?
এ প্রতিবেদনে জেনে নিন এরকম ১২টি জীবন্ত জিনিস ও তাদের আবাসস্থল সম্পর্কে।
এক লাখ বছরের পুরোনো সমুদ্র ঘাস
স্পেনের বেলারিক দ্বীপের উপকূলে সাগরের তলদেশে প্রায় এক লাখ বছর পুরোনো সি-গ্রাস বা সমুদ্র ঘাসের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ব্রকলিন শিল্পী রাসেল সাসম্যন তার বিখ্যাত ‘দ্য ওল্ডেস্ট লিভিং থিংস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটিতে এই ঘাসের একটা ছবি অর্ন্তভুক্ত করেছেন এবং ‘সময় ও স্থানের বিচারে মহান জীবনযাত্রা’ হিসেবে এটিকে অভিহীত করেছেন।
ধারণা করা হয়, বেলারিক দ্বীপের উপকূলে পাওয়া এই সমুদ্র ঘাস পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত বিস্ময়। যার আনুমানিক বয়স প্রায় এক লক্ষ বছর। প্রাচীন এই ডুবোঘাসগুলো প্রায় ১০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রজাতিটি ফুল ও ফল ধারণে সক্ষম। সাগরতলের এই বিস্ময় রক্ষা করতে সে দেশের সরকার একটি নৌ-শিপিং রুলস জারি করেছে।
৮০ হাজার বছরের পুরোনো ও দৈত্যাকৃতি প্যান্ডো গাছ
প্যান্ডো পৃথিবীর দীর্ঘ ও প্রাচীনতম উদ্ভিদ বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। হিসাব মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উতাহ রাজ্যের এই প্যান্ডো বাগানটি প্রায় ৮০ হাজার বছরের পুরোনো। প্রথমে একটি গাছ থেকে পরে বাগানের সৃষ্টি। এটা উতাহ এর ফিশলেক ন্যাশনাল ফরেস্টের মধ্যে অবস্থিত। বিশ্বাস করা হয় যে, এই প্যান্ডো বাগানটি পৃথিবীর প্রথম ভারী কান্ড বিশিষ্ট বৃক্ষের বাগান। এখানকার চল্লিশ হাজার বৃক্ষের কান্ডের ওজন আনুমানিক ১৩ হাজার পাউন্ড।
এই দৈত্যাকৃতির বৃক্ষরাজি দ্রুত বর্ধনশীল। এর অধিক আয়ুর পেছনের কারণগুলো হল- এই গাছগুলো প্রচন্ড খরা প্রতিরোধী এবং পোকামাকড় এর কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
১৫ হাজার বছরের পুরোনো স্পঞ্জ
অ্যান্টার্কটিকার ঠান্ডা পানির নিচে বৃহৎ আকৃতির স্পঞ্জ পাওয়া গেছে যেটা ধারণা করা হয় আগ্নেয়গিরির উদগীরণে সৃষ্টি। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, এটা প্রায় ১৫ হাজার বছরের পুরোনো। এটা অ্যান্টার্কটিকার ম্যাকমুরদো সাউন্ড নামক বরফ পানি অঞ্চলের নিচে প্রায় ১৫ হাজার বছর যাবত রয়েছে। ফ্যাকাশে হলুদ রঙের জলজ নমনীয় এই বস্তুটি লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে চার ফুট। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান সাগরতলের পানির স্রোত একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায় বহমান। এই প্রবাহই স্পঞ্জটির বৃদ্ধি ও আয়ু বর্ধিতকরণে দায়ী।
বরফের ন্যয় পানির ৯৮ ফুট অতলে থাকার ফলে এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
১৮৪ বছর বয়সি কচ্ছপ
সিসিলিতে জন্ম নেওয়া জনাথন নামক এক কচ্ছপের বর্তমান বয়স ১৮৪ বছর। জনাথন তার প্রত্যাশিত ১৫০ বছর বয়স পার করেছে অনেক আগেই। দানবাকৃতির এই কচ্ছপটি এখন ১৮৪ এর কোঠা অতিক্রম করছে।
পঞ্চাশ বছর বয়স থাকাবস্থায় তৎকালীন সিসিলির গভর্নরের উপহারস্বরুপ জনাথনকে দক্ষিণ আটলান্টিকের ছোট দ্বীপ সেন্ট আইল্যন্ডে নিয়ে আসা হয়। গভর্নর হ্যরিয়েটের মৃত্যুর পর ১৭৫ বছর বয়সি দানবাকৃতির এই প্রাণীটিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১২০ বছর বয়সি টুয়াটারা
গিরগিটি প্রজাতির এই প্রাণীর দীর্ঘায়ু অনেক। নিউজিল্যান্ডে হেনরি নামক এমনই এক টুয়াটারার সন্ধান মিলেছে যার বয়স ১২০ বছর। এটা নিউজিল্যান্ডের প্রাচীনতম প্রাণী। গিরগিটির এই প্রজাতিটি সেই ডাইনোসর যুগ থেকেই তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। টুয়াটারাটি এখন নিউজিল্যন্ডের সাউথল্যন্ড মিউজিয়ামের আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে।
৮০ বছর বয়সি অ্যালিগেটর
সার্বিয়ার বেলগ্রেড চিড়িয়াখানায় রয়েছে ৮০ বছর বয়সি এক অ্যালিগেটর। অ্যালিগেটর কুমিরের ন্যয় দেখতে ও স্বভাবে একইরকম এক মেরুদন্ডী প্রাণী। মুজা নামক এই অ্যালিগেটরটির আদি নিবাস আমেরিকায়।
বেলগ্রেড চিড়িয়াখানার আদি বাসিন্দা তথা প্রাণীগুলোর জন্য বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। মুজা নামক এই অ্যালিগেটরটি চিড়িয়াখানার সর্বাপেক্ষা বয়স্ক প্রাণী। উপরন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে, এটা আমেরিকার সবচেয়ে বয়স্ক অ্যালিগেটর।
১৯৩৭ সালে মুজাকে প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় সার্বিয়ায় নিয়ে আসা হয়। তার এক বছর পরে এই চিড়িয়াখানা খুললে মুজাকে এখানে রাখা হয়। মুজা একটি বিশ্বযু্দ্ধ, তিনবার বোমা হামলা এবং ১৯৯০ বলকান সংকটেরও মুখোমুখি হয়েছে।
চিড়িয়াখানাটি শহরের ভেতরে বেলগ্রেড দূর্গের ভেতরে হওয়ায় ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ঘটে চলা বোমা হামলায় অনেকটা বিধ্বস্ত হয়। অনেক প্রাণীও সে সময়ে মারা যায়।
৪০০ বছরের পুরোনো আঙুর গাছ
প্রাচীন এ আঙুর গাছটি রয়েছে ঐতিহাসিক শহর স্লোভেনিয়ার মেরিবোর এলাকায়। ধারণা করা হয় এর বয়স ৪০০ বছরের বেশি। এটা খুব সম্ভবত মধ্যযুগের কোনো সময়ে রোপন করা হয়েছিল। প্রাচীনতম ফল প্রদানকারী বৃক্ষ হিসেবে এটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখায়।
এখন পর্যন্ত বছরে প্রায় ৭৭ থেকে ১২০ পাউন্ড আঙুর ফলে এই গাছটিতে। আঙুরগুলো থেকে তৈরি ওয়াইন পোপসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ।
৫ হাজার বছরের পুরোনো ফোর্টিঙ্গাল ইউ গাছ
স্কটল্যন্ডের একটি চার্চের সামনে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার বছর পুরোনো এক ফোর্টিঙ্গাল ইউ নামক গাছ। ইউ গাছ সাধারণত প্রাচীন আফ্রিকান প্রজাতির একটি বৃক্ষ যেগুলো তুলনামুলক ধীর বর্ধনশীল হয়ে থাকে। এই ধরনের বৃক্ষের সঠিক বয়স বের করাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফোর্টিঙ্গাল শহরে গাছটি হওয়ায় এর নাম রাখা হয় ফোর্টিঙ্গাল ইউ।
৫০ বছর বয়সি কালো গন্ডার
তানজানিয়ার নরঙ্গোরো এলাকায় ফুয়ান্টা নামক এক কালো গন্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে যেটা আনুমানিক পঞ্চাশোর্ধ এবং ধারণা করা হয় এটাই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বয়স্ক কালো গন্ডার। হায়েনা কর্তৃক আক্রমণের শিকার হওয়া গন্ডারটি বর্তমানে এক সংরক্ষক দলের হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু এই নারী গন্ডারটি নানা জটিল রোগে ভুগছে। তাই বন্য জগতে আর ফিরতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে চিকিৎসকরা সন্দিহান।
১ হাজার বছরের পুরোনো গোলাপ গাছ
জার্মানির হিলসহেম ক্যথিড্রালে রয়েছে এক বিস্ময়কর গোলাপ গাছ, যার ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরোনো। বুনো প্রজাতির এই গোলাপ দেয়ালের গা ঘেষেই বেড়ে উঠেছে এবং নানান চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে পার করে ফেলেছে হাজার বছর। প্রায় তেত্রিশ ফুট দীর্ঘ এই গোলাপ ঝোপটি বুনো অথবা ‘রোজ ক্যানিনা’ গোত্রীয়।
নথি মোতাবেক এর বয়স প্রায় ৭০০ বছরের বেশি। তবে বিশিষ্টজনদের মতে, এটা হাজার বছরেরই হবে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ক্যথিড্রাল এলাকায় বোমা হামলায় গাছটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে শিকড়ের মাধ্যমে এটা আবার পুনর্জন্ম লাভ করে।
৪ হাজার বছরের পুরোনো জলপাই গাছ
গ্রিক এর একটি দ্বীপ ক্রিট। আর এই ক্রিটের এনো ভোবস নামক গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরোনো এক জলপাই গাছ। ১৯৯৭ সালে এটিকে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এটা পৃথিবীর প্রাচীনতম ফল প্রদানকারী বৃক্ষের অন্তর্ভুক্ত কারণ এখন পর্যন্ত এই গাছে জলপাই ধরে। ক্রিট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এর বয়স দাবি করেন ৪ হাজার বছর। কিন্তু আরেক গবেষণায় এর বয়স দাড়ায় দুই হাজার বছরের কাছাকাছি। তাই এর সঠিক বয়স নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার দর্শনার্থী এই গাছটি পরিদর্শনে আসেন।
৬ হাজার বছরের পুরোনো বাওবাব গাছ
দক্ষিণ আফ্রিকার লিম্পোপোতে সানল্যন্ড নামক পার্কে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাওবাব বৃক্ষ। বাওবাব আফ্রিকান প্রজাতির স্থুল কান্ডবিশিষ্ট বৃক্ষ যাদের দীর্ঘায়ু রয়েছে। গাছটির আনুমানিক বয়স ছয় হাজার বছর। সম্প্রতি এটি মৃতপ্রায়। যথেষ্ট প্রশস্ত এই বৃক্ষের চল্লিশটি শাখা অনেকটা জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। আফ্রিকার অতিপ্রাচীন বৃক্ষ হিসেবেও ধরা হয় এটিকে। দুর্ভাগ্যবশত কিছুদিন আগে গাছটির একটি প্রধান শাখা ভেঙে পড়ার পর থেকেই গাছটি অন্তিম পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ধারণা করা হয়, এটা মিশরের গিজা পিরামিডেরও আগেরকার। এটা সত্যি বলতে এখন পর্যন্ত এক জীবন্ত বিস্ময় পৃথিবীর কাছে। প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজারের বেশি দর্শনার্থী গাছটিকে পরিদর্শনে আসেন। বৃক্ষটির স্তম্ভ দেয়ালে ১৫ জন বসার মতো স্থান রয়েছে যেখানে দর্শনার্থীদের ওয়াইন পরিবেশন করা হয়।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।