আমার জীবনের দীর্ঘতম বন্ধুত্বের স্মৃতি যাকে নিয়ে, সেই বন্ধু, আবার সে পারিবারিক দিক দিয়ে আমার কাকু, কিন্তু বন্ধুসুলভ ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, যার সম্পূর্ণ নাম আশীষ বড়ুয়া। যার অনেক বেশি পরিচিতি ডাকনাম বাপ্পু দিয়ে, এভাবে আমাকে শেষ চমক দিয়ে চলে যাবে, আমি কখনো ভাবতে পারিনি। সারা জীবন সে আমাকে অনেক চমক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দুজনের এই পরিণত বয়সেও সে আমার আগে জীবন থেকে বিদায় নেবে, আমার কল্পনারও অগোচর ছিল এটা। তার স্বভাবেই ছিল চমক দেওয়া, সেই তার ছাত্রজীবন থেকে। সে কোটবাজারের পালং স্কুল থেকে লেখাপড়ার মধ্য জীবনে চলে আসার পর আমরা দুজনেই ছিলাম মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে। আশীষ আমার সিনিয়র ছিল। কিন্তু তখন তেমন বন্ধুত্ব পূর্ন ছিলাম না। এসএসসির পর কোন কারনে দুজনে ইয়ার মেট হয়ে যায়। খুব বন্ধুত্ব ছিল আমার এই কাকুর সাথে। কলেজ জীবনে দুর্ভাগ্যবশত আশীষের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে । যা মেনে নেওয়া অবিশ্বাস্য। তারপরও মনে কস্ট রেখে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করত আমার এই প্রানপ্রিয় বন্ধু আশীষ। কাউকে বুঝতে দিত না তার কস্ট।
যা হোক, কলেজ জীবনে প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল। কিন্তু আশীষ পারল না দিতে। কারন আবারো চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যেতে হল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। তখনো গেল আরো এক বছর বাদ। চিকিৎসার পর দেশে এসে আবারো শুরু করে কলেজ জীবন এবং তার লেখাপড়া। আবারো স্বপ্ন দেখেছিল স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকার। যতই দিন গড়াচ্চে তার জীবন উজ্জল হতে শুরু করে। তার জীবনে এই অল্প সময়ে চলে আসে প্রেম, ভালবাসা ইত্যাদি। আনন্দের ঘনবাতাস বইতে শুরু করে আশীষের জীবনে। এরই মাঝে এইচএসসি পরীক্ষাও সম্পূর্ণ করে এবং ভাল একটা ফলাফল অর্জন কৃতকার্য হয়।
অল্পতে সে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বৈবাহিক জীবনে নেমে পড়েন। শুরু করেন নতুন জীবনের আরেকটা সিড়ি। শুরু হল হাস্যোজ্যল জীবনের অন্য দ্বারা। অনেক হাসি -খুশিতেই যাচ্ছিল তার দিন। লেখাপড়ার ফাকে সে দেশের স্বনামধণ্য দেশ ট্রাভেলস এ চাকরি শুরু করেন। পরে পদোন্নতি ও হয় তার।
কে জানত তার জীবনে আবারো সেই কাল নেমে আসবে? আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে সেই পুরনো রোগে।
তখন চাকরী থেকে তার পরিবার জোর করে বাড়িতে নিয়ে আসে। এবং চিকিৎসা শুরু করে। বাংলাদেশের বড় বড় ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্লাড বদলাতে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তার পরিবার বর্গের।
গেল ১৪ মার্চ মঙ্গলবার, আমি, তুষার দা, এ্যপোলো দাদা, রাশেল সবাই আশিষ কে বাড়িতে দেখতে যাই এবং অনেক দুষ্টমি করি। সেইদিন ভিসার কাজে তার বাবা (মাষ্টার অমিয় কুমার বড়ুয়া) সহ যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। অতর্কিত অবস্থায় আচমকা ১২.৪৫ মিনিটে ফোন আসে দাদা মিশুর ফোন থেকে। সেই মুহুর্তে এমন একটা সংবাদ শুনলাম যা শুনতে একদম অপ্রস্তুত। তখন বিশ্বাস হচ্ছে না বিষয় টা। আরো কয়েকজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম প্রানপ্রিয় বন্ধুসুলভ কাকু আশীষ আর আমাদের মাঝে নেই।
একই সঙ্গে, কত দুঃসাহসিক ছিল তার সরল জীবন, ধর্মের দিক দিয়ে, প্রতিবেশীদের দিক দিয়ে সে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। উখিয়ার সহ বিভিন্ন জায়গার অনেক ধর্মীয় গুরুর সাথেও তার পরিচয়। আমার ধারণায়, তার দুঃসাহসিকতার অন্যতম প্রমাণ। এই দুঃসাহসের উৎস কোথায়? আমার মনে হয়, বিস্তর পড়াশোনার মাধ্যমে অর্জিত তার অসম্ভব আত্মবিশ্বাসে। যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসে, তেমনি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই মায়াহীন পৃথিবী নিয়েও তার বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল দৃঢ়। সেই অর্থে সে ছিল একজন আপাদমস্তক আস্তিক্যবাদী। তার আস্তিকতা ছিল সর্বব্যাপী। অন্যের সমস্যাকে সে কখনো খাটো করে দেখেনি, শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখত অন্যের ভবিষ্যতের ওপর, মাতৃভুমির ওপর। সে কেবল নিজের মাতা-পিতা নয়, সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা ভেবেছে। এবং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
সুতরাং তার মৃত্যুতে সব ব্যক্তি, সব মহল যে কথাটা বলেছে, দেশের ক্রান্তিকালে সে ছিল এক পরম আস্থা ও ভরসার কেন্দ্র। কথাটা একটুও মিথ্যা নয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আশীষ দৃষ্টি রেখেছে সব ঘটনার ওপর। নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখেনি, নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে। সব জায়গায় যায়নি, সবার সঙ্গে মেশেনি, তবে নিজেকে সবার থেকে দূরবর্তীও করেনি। নিজের স্বাতন্ত্র্যকে একটুও খর্ব না করে সে সবার মধ্যে একজন, সবার জন্য একজন—এই পরিচয় রেখে গেল। ভুলব না তারে কোনদিন। বেঁচে থাকবে সারাজীবন আমাদের মাঝে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।