আমরা নানা ক্ষেত্রে ভারতকে সহযোগিতা দিচ্ছি ও নিচ্ছি। বিশ্বায়নের শর্তও তা-ই, দেব ও নেব—দুটোরই গলায় গলায় ভাব থাকবে। অর্থনীতি বলুন, বাণিজ্য বলুন কিংবা ধরুন ঐশ্বর্য রাইয়ের অভিনয়; আমরা ভারতের আরও কত কিছুতেই না মুগ্ধ হই। সুতরাং আসুন আমরা আরও অনেক কিছুর মতো এবং যা সংগত, তেমন করে ভারতের আইনকানুন ও গণতন্ত্রসম্মত রীতিনীতিকেই বেশি বেশি ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ভাবি, আওয়ামী লীগের কক্সবাজারের বিতর্কিত সাংসদ বদি সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। দণ্ডিত হলে পদ খোয়ানোটা ভারতে এখন সবাই মানছে।
সেদিন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাড়ে তিন ঘণ্টা কথা হলো। তিনি আক্ষেপ করছিলেন এই বলে যে নেহরু যা পারলেন, উপমহাদেশে অন্যরা তা পারলেন না। তিনি বলছিলেন, রাষ্ট্র গঠনে নেহরু দুটি বিষয় স্থির করেছিলেন বলে ভারত আজ এতটা এগিয়ে। এক. তিনি মেনেছিলেন যে জনপ্রশাসন ব্রিটিশ আদলে হবে, এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে। দুই. বিচার বিভাগ হবে গুণগতমানের ভিত্তিতে। এখানে সংখ্যা নয়, গুণমানই হবে মাপকাঠি। নেহরু সেই ধারাটি বেঁধেছিলেন বলেই হয়তো আজ ভারতের বিচার বিভাগ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জনস্বার্থ রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী। এমনকি বলদর্পী নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগকে সামাল দিতেও এক অনবদ্য অতন্দ্রপ্রহরী।
কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদি সম্পর্কে এ প্রসঙ্গ এই কারণে যে ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা এমন কিছু বিস্ময়কর কাণ্ড করেছেন, যা বিশ্বরাজনীতির জন্য একটা মধুর অভিজ্ঞতা। রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক থাকবে কি থাকবে না, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে শেষ হাসিটা কে দেবে, সরকার না বিচার বিভাগ? নির্বাচনে একজন প্রার্থী হতে হলে তার কী কী গুণ, যোগ্যতা আর কী কী দোষ করলে সেসব অযোগ্যতা বলে গণ্য হবে? জনগণের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে প্রার্থী তাঁর নিজের সম্পর্কে কী কী তথ্য প্রকাশ করবেন? দলগুলো তাদের আয়-ব্যয় প্রকাশ করবে, নাকি গোপন রেখে পার পাবে? সংসদে একটি সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর সেটা ‘মৌলিক কাঠামো’র (যা অনির্দিষ্ট, অসংজ্ঞায়িত) দোহাই দিয়ে বাতিল হতে দেওয়া ঠিক কি বেঠিক? এবং সর্বোপরি একজন সাংসদ ফৌজদারি আইনে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পরও সংসদে তাঁর পদ থাকবে কি থাকবে না?
আমরা সবাই একমত হব যে এই প্রশ্নগুলো একান্তভাবেই রাজনৈতিক। কারণ, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুশীলবদের সবাই আপাদমস্তক রাজনীতিক। এই প্রশ্নগুলো ইংল্যান্ডের হাউস অব কমনস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তাদের ইতিহাসজুড়ে খোলামেলা বিতর্ক করেছে এবং লিখিত বা অলিখিত একটা নিয়ম বেঁধে নিয়েছে। আর তাতেই তারা বহুকাল আগে থেকেই কমবেশি স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়েছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্ন। উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে ভারতীয় রাজনীতিকেরা বরাবর পলায়নপর থেকেছেন। বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি রাজনীতিকেরাও পালিয়েছেন। কিন্তু তফাত হলো, ভারতীয় রাজনীতিকেরা তাঁদের নাছোড়বান্দা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, উল্লিখিত ইস্যুগুলোর প্রায় প্রতিটিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রধানত জনস্বার্থে করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিকদের কমবেশি ‘পরাজয়’ নিশ্চিত করেছেন।
বহু বছর ধরে অনুশীলন করার পর, বিচারপতি নিয়োগে লোকসভা এক বিরল সর্বসম্মতিতে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করার পর সম্প্রতি আমরা দেখলাম, সুপ্রিম কোর্ট কী অবলীলায় তা ছুড়ে ফেলে দিলেন। ভারতীয় রাজনীতিকেরা চাইলে তাঁদের সুপ্রিম কোর্ট যে সংবিধানসম্মত কাজ করেননি, তেমন যুক্তি তুলে ভারতবাসী ও বিশ্বের সামনে প্রচার করতে পারতেন। কিন্তু দু-চারটি সংযত মন্তব্য ছাড়া তেমন কিছু নজরে পড়ল না। তবে ভারতীয় রাজনীতিকেরা সে জন্য শুধুই যে প্রশংসার দাবিদার তা হয়তো নয়। তাঁরা তাঁদের কাজটুকু যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতেন, তাহলে সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য আরও ভালো হতো। কিন্তু যেটা শিক্ষণীয় তা হলো, নেহরুর মানের প্রধানমন্ত্রী ভারতের ৬৯ বছরের ইতিহাসে কম এসেছে। কিন্তু বলা চলে সেই মানের যে ঘাটতি, সেটা উল্লেখযোগ্যভাবে পূরণ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। আর সংক্ষেপে সেটা বেশ খানিকটা বা প্রধানত সম্ভব হয়েছে বিচারপতি নিয়োগে দলীয় হস্তক্ষেপ ন্যূনতম রাখতে সব দল–নির্বিশেষে একমত হতে পারায়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং রাজ্যগুলোতে হাইকোর্টগুলোর বিচারক নিয়োগ তাঁদের আইনসভাগুলোর গড় রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানের চেয়ে ঊর্ধ্বে রাখা সম্ভব হয়েছে। এটা আমরা পারলাম না। তাই বলি, নিজেদের ও জাতিকে বাঁচাতে চাইলে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে এই সত্য মানতেই হবে। সন্ত্রাস দমনে একত্রে পথ চলতে চলতে ভারতের এই পথেও বাংলাদেশকে যেতে হবে। সম্ভবত ভারতও ওই পথে হাঁটতে বাংলাদেশকে উৎসাহিত করতে পারে।
আপনি আমাদের ইতিহাসের এমন কোনো একটিও আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য রায় দেখাতে পারবেন না, যার ভিত্তি তৈরিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কাদামাটির ছাপটি একদম নেই। আমাদের রাজনীতিকেরা এ ধরনের সত্য সভা-সমিতিতে পারতপক্ষে উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকেন। আমাদের যেসব তারকা আইনজীবী রাজনীতির অঙ্গন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের মুখেও এই নিরীহ সত্যটি কখনো সেভাবে উচ্চারিত হতে দেখিনি। আমাদের গত ৪৫ বছরের আইনের মূলনীতি তৈরির ভান্ডারের অন্তত ৫০ ভাগের বেশি উৎস ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টগুলোর রায়। এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের যেসব সুনীতি মানলে বদি–বধ কাব্য রচনা সম্ভব, তা অনসুরণে কোনো ধরনের লক্ষণ দেখি না কেন?
তাই বলি, ভারতীয় বিচার ও আইনি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে সংসদ থেকে আবদুর রহমান বদির পদ শূন্য ঘোষণা করুন। কক্সবাজারের বদি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের উপাখ্যানে একটি জমকালো নাম। নির্বাচন কমিশনের সদ্য অবসরে যাওয়া এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিলেন। বললেন, তাঁদেরই এক নির্বাচন কর্মকর্তাকে বদি নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছিলেন। স্পিকারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। টেলিফোনে তিনি কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি যেন রবিঠাকুরের ভাষাতেই বলছিলেন, ‘আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে।’ এই বন্ধুটি দীর্ঘকাল নির্বাচন কমিশনের আইনকানুন ও আদালতের রায় বাস্তবায়নবিষয়ক বিভাগের হর্তাকর্তা ছিলেন।
তাঁকে প্রশ্ন করি, কোনো সাংসদ দণ্ডিত হলে তাঁর সদস্যপদ চলে যায় না বলে যে নিয়ম চলছিল, সেটাই কি আজও চলছে? তাঁর হ্যাঁ-সূচক উত্তর শুনে আমি অবাক হই না। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলায়, এই বাংলাদেশেও অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু যেন একটুও বদলায় না শীর্ষস্তরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ‘স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনবিরোধী শক্তিগুলোকে’ গত কয়েক বছরে নাস্তানাবুদ করার সরকারদলীয় দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে অসুরের বিরুদ্ধে ভারতের সুন্দর উদাহরণগুলো আমরা অনুসরণে কেন আগের মতোই অক্ষম থাকব? বদি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, ব্যাংকার, ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী প্রকৌশলী, বন কর্মকর্তা, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাসহ ২৪ জনকে নিজের হাতে পিটিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খাতায় তিনি ইয়াবা-সম্রাট ধরনের কিছু। মানব পাচারেও তিনি সন্দেহভাজন। অবৈধভাবে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল, তাতেও তাঁর যুক্ত থাকার বিষয়ে অভিযোগ আছে।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ দফার ঘ উপদফায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হবার এবং সংসদ সদস্য থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি “তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দু বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে”।’ আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকেই ২০০১ সালে হাইকোর্টে থাকতে জেনারেল এরশাদের জনতা টাওয়ার দুর্নীতির মামলায় রায় দেন যে ‘আপিল করলেও দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সাজা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সংসদের সদস্যপদ থাকবে না।’ সেই হিসাবে সংসদে বদির পদ নেই। কিন্তু যেটা দেখার বিষয়, আমাদের গণমাধ্যম বদিবিরোধী হলেও কেউ ওই রায়টি স্মরণ করেনি। কারণ তারা জানে, ওই রায় নীতিনির্ধারণী রাজনীতিকদের কাছে একটি কাগুজে দলিল ছাড়া কিছু নয়। সুতরাং কথা হলো, নেহরুর মতো একটি অভিপ্রায় শীর্ষ নেতৃত্বের থাকতে হবে। পরিবর্তন চাইলে এটা নিচ থেকে হবে না, ওপর থেকেই আসতে হবে। এটা যত দিন না আসবে, তত দিন আমরা ন্যূনতম আইনের শাসন কার্যকর করতে পারব না। দণ্ডিত মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিত্ব করবেন। দণ্ডিত সাংসদ সংসদে বসবেন। আর সেই সমাজে সন্ত্রাস–জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবে না, সেটা তো যুক্তির কথা হবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
সুত্র: প্রথম আলো
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।