২৫ নভেম্বর, ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  ব্যাটারী চালিত ই-বাইক মালিক সমিতি মরিচ্যা ও মৌলভী পাড়া কমিটি অনুমোদন   ●  টেকনাফ সমুদ্রে গোসলে নেমে মাদ্রাসার এক ছাত্রের মৃত্যু দুই ছাত্র নিখোঁজ।   ●  মাকে হত্যার পর থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ।   ●  মারমেইড বীচ রিসোর্টে বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান   ●  যারা খেলাধূলা করছে, তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না   ●  উখিয়ার নতুন ইউএনও কামরুল হাসান চৌধুরী   ●  উখিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার   ●  ছয় কোটি তরুণের দেয়াল লিখন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান   ●  চকরিয়ায় ২টি ডাম্পার ট্রাক ও এক্সকেভেটর জব্দ   ●  ধরে নিয়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশী  জেলেকে ফেরত দিল আরাকান আর্মি

বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মহামানব জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল ছায়া গাঁয়। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ছেলেবেলায় বাবা-মা ডাকতেন খোকা বলে। কিশোর বয়সেই মানুষের প্রতি অগাধ মায়া-মমতা। গরিবের পাশে দাঁড়ানো চরিত্রে দেখা যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর। মা আদরে প্রশ্রয় দিতেন। বাবা চাইতেন লেখাপড়া করবে। ব্যারিস্টার হবে। ছেলে অল্প বয়সেই পাঠ নিলেন রাজনীতিতে। কলকাতায় পাঠানো হলো পড়াশোনায়। সেখানেই ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়। নেতৃত্বে সাহসে সাংগঠনিক ক্যারিশমায় রাজপথের প্রতিবাদে নজর কাড়লেন সবার। তরুণদের মুজিব ভাই হতে থাকলেন। তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ালেন। স্নেহ-সান্নিধ্য পেলেন মহাত্মা গান্ধীর। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের। মওলানা ভাসানীর পরে। শেরেবাংলা সম্পর্কে নানা হলেও তার নেতা হলেন সোহরাওয়ার্দী। একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে সততা সাহস নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে, দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর মমতা নিয়ে তিনি রাজনীতির মঞ্চে তাঁর আবির্ভাব ঘটালেন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জিন্নাহ ইসলাম মুসলমান পাকিস্তান-এ চার অনুভূতি নিয়ে জন্ম নিলে শেখ মুজিবুর রহমান এটাকে মেনে নেননি। এক বছর না যেতেই তিনি ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি রুমে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। পরের বছরই আওয়ামী লীগের জন্ম। কারাগারে বসে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও কর্মী দরদি মন আর সাংগঠনিক শক্তিতে তিনিই হলেন দলের প্রাণ মধ্যমণি। ভাসানী বেরিয়ে গেলেন। সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু পাকিস্তানি শাসকদের কঠিন দুঃশাসন, তাদের প্রতাপশালী তাঁবেদার রাজনৈতিক শক্তি, সব প্রতিকূলতা তাঁকে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের সিঁড়িপথে জেল জুলুম সয়ে একটি জাতিকে ছয় দফা থেকে স্বাধিকার স্বাধীনতার পথে তিনি জাগালেন। ’৬৯ সালে ৩৮ মাসের কারাশৃঙ্খল ভেঙে তিনি গণঅভ্যুত্থানে বের হলেন যখন তখন জাতির অবিসংবাদিত নেতাই নন, নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন লাখ লাখ জনতার চিৎকারে আনন্দে। তিনিই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন দুর্ধর্ষ সাহসে লড়েছেন এবং সব পরিকল্পনায় কোথাও ভুল না করে সফল হয়েছেন। কোনো আলোচনার পথে নয়, কোনো গোপন রাজনীতির অন্ধকার পথেও নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে জনগণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জনগণকে নিয়ে অকুতোভয় এক দুঃসাহসী নেতা হিসেবে এই বিপ্লবের বিরল ইতিহাস গড়েছেন। এমন সুদর্শন নির্লোভ দুর্ধর্ষ সাহসী নেতা ও সুপুরুষ বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসেই নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও আসবে না। ’৭০-এর নির্বাচনে তিনি ঐক্য গড়েননি, নিজের ইমেজে দলকে নিরঙ্কুশ বিজয়ে জাতির নির্বাচিত একক নেতার উচ্চতায়ই বসাননি, স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ বাংলায় জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করেছেন। তিনি স্বাধীনতার ডাকে যে মোহনবাঁশিতে সুর তুলেছিলেন গোটা জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ গণহত্যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সেই সুরের জাদুতে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। তিনিই প্রমাণ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতায় জীবন তুচ্ছ। ত্যাগের কোনো বিকল্প নেই। তাঁর পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী আমরা কত রক্ত আর লড়াইয়ে। ৫৫ বছরের জীবনে ৫০ বছরেই তিনি জাতির পিতা হলেন। একজন মহান নেতা এমনি হয় না। ৫০ বছরের ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ফাঁসির রশি বারবার ঝুলেছে, কবর খোঁড়া হয়েছে, আপস তাঁর চরিত্রে ছিল না। দেশটাই বাড়ি জনগণই তার পরিবার। এমন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও বিশ্বের তাবৎ শোষিত মানুষের হয়ে তেজোদীপ্ত ভরাট কণ্ঠের দীর্ঘদেহী ব্যক্তিত্ব ও কোমল হৃদয়ের উদার গণতান্ত্রিক নেতার আবির্ভাব বিশ্বরাজনীতিতে আসবেন না। ৭ মার্চের মতোন এমন ১৮ মিনিটের ভাষণে রাজনীতির কবিও জন্ম নেবেন না। পাকিস্তানি শাসকদের অস্ত্রের শাসনকে অচল করে দিয়ে গোটা দেশে ক্ষমতায় না গিয়ে প্রতিটি নির্দেশ জনগণের মাঝে কার্যকর করে তিনিই বলতে পেরেছিলেন, আমিই রাষ্ট্র। এই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের আত্মা ও আদর্শ। বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই সৎ নির্লোভ চরিত্রে দেশ ও মানুষকে, জনগণের স্বার্থকে হৃদয়ের ভালোবাসায় ধারণ করে মানবকল্যাণে নিবেদিত করা। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত মানবিক উন্নত আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ।
এ দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সত্যকে আড়াল করতে যে যার মতো লজ্জাজনকভাবে মিথ্যাচার করেছেন। ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জ বেহায়াপনায় যার যার মতোন বলেছেন ও লিখেছেন কিন্তু পাকিস্তানের গোয়েন্দা নথি থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের অবমুক্ত দলিল, পরাজিত শক্তির লেখা বইসহ সবখানে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার একমাত্র স্তম্ভ। গৌরবের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকা ভারতের নথিপত্র থেকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মূল সত্য এখনো বহাল। সব সূত্র বলছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সফলতা দক্ষতার সঙ্গে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম দুর্ধর্ষ এক সাহসী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, মহানায়ক ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধ তাঁর ডাকেই সংঘটিত হয়েছে। সব কিছুর মূলে ছিল তাঁরই পরিকল্পনা এবং নির্দেশ। বঙ্গবন্ধুর মোহনবাঁশিতেই ’৭১ সালের মার্চে গোটা জাতি উত্তাল হয়ে তার অঙ্গুলিহেলনে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে।
সম্পর্কিত খবর

বিশ্বের ৭৭ মিশনে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ উদ্বোধন
মহানায়কের নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রইলো সিড়ির কোনায়
বাঘিয়াপাড়ের হিজলতলায় জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি
ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি এখন লন্ডনে অবসর জীবনের পড়ন্ত বেলায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে লেখা চিঠি হস্তান্তর করে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জিকে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে সমমর্যাদার বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন চাইছি। মাথা নত করে হাত পাতছি না। চীনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ভারত এখন দুনিয়ায় ইজ্জত হারিয়েছে। আমাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা ও সমর্থন দিলে ভারতের হারানো ইজ্জত যেমন ফিরে আসবে, মর্যাদা যেমন বাড়বে; তেমনি আমার বাঙালি স্বাধীন আবাস ভূমি পাবে। আমরা স্বাধীন হব।’ সেই সময় পূর্ববাংলার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপ-দূতাবাসের রাজনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এসব কথা বলেছেন। ১০ জুলাই ২০১৯, সামারের চমৎকার বিকালে তাঁর লন্ডনের বাসভবনে টানা দুই ঘণ্টা তিনি আমার সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধুই যে মহান স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, পরিকল্পনাকারী এবং দুঃসাহসী নেতা হিসেবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাস্তবায়ন করেন তার নির্মোহ ইতিহাস তুলে ধরেন।

১৯৫৫ সালে ফরেন চাকরিতে যোগ দেওয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জি ’৮৫ সালে অবসর নেন। ’৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এমন সুপুরুষ, এমন কণ্ঠ ও সহজ সরল ভাষার বক্তৃতায় জনগণকে তীব্রভাবে আকর্ষণ, উদ্দীপ্ত, উত্তেজিত ও সংগঠিত করার মতোন, একজন অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক ও অমায়িক ব্যবহারের বিচক্ষণ নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেছেন, ১৯৬০ সালে তাঁকে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে ভারতীয় উপ-হাইকমিশনে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় আসার আগে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যদিও তখন আওয়ামী লীগ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৬২ সালের ২৫ মার্চ ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসব। তখন তিনি পুরান ঢাকার চক্রবর্তী ভিলায় বসবাস করেন। বাড়িটির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক অফিস। ২৪ ডিসেম্বর রাতে তিনি তাঁর সহধর্মিণীসহ এক সহকর্মীর বাসায় বড়দিনের আনন্দ অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ শেষে রাত ১২টার পর পর বাসায় ফিরে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পান। দরজা খুলে দেখেন ১৪ বছরের এক ভদ্র, বিনয়ী অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে। সালাম বিনিময় করে সেই কিশোর ছেলেটি তাঁকে বলল, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আপনাকে নিয়ে যেতে আমাকে পাঠিয়েছেন। দরজা খোলার আগে কড়া নাড়ার শব্দে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, মধ্যরাতের পর এই অসময়ে কে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল? তিনি ভ্রƒকুঁচকে ভাবছিলেন, কেউ কি তাঁকে অনুসরণ করছিল? ঢাকায় আসার আগে তাঁকে নিজের এবং পরিবারের অতিরিক্ত নিরাপত্তায় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখা নিয়মিত পড়ে মুগ্ধ হলেও কখনো দেখা হয়নি। ছেলেটি আরও বলল, মানিক মিয়ার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক আছেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোক কে? ছেলেটি তা আর বলল না। তিনি ইতস্তত করে করে গোলকধাঁধার মতো মানিক মিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বসলেন। যা ছিল প্রথাবিরোধী। ব্যানার্জি বলেন, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যাই ঘটুক না কেন আমি সেই অজানার উদ্দেশ্যে যাব।’ ছেলেটিকে বলে দিলেন, চলে যেতে এবং মানিক মিয়াকে জানাতে যে, কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি দেখা করতে আসছেন।

শশাঙ্ক ব্যানার্জির ভাষায়, পরিচয়ের সময় মুজিব শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং তাঁকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাঁকে বললেন, আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে তুমি বলতে পারব না। শেখ মুজিব তাঁর চোখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন ভীষণ জরুরি একটা কিছু বলার জন্য তিনি উসখুস করছেন। হাসিমুখে চোখ মিটমিট করে তাঁকে ব্যানার্জি বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। তবে জানতে চাইছি, এটা কি একটি ঐতিহাসিক করমর্দন? শেখ মুজিবের ত্বরিত জবাব ছিল, কেন নয়? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলেছিলেন, এই সোভিয়েত নেতার সঙ্গে পশ্চিমের লেনদেন সম্ভব। তেমনি এ ঘটনার অনেক বছর আগে ’৬২ সালের শীতের রাতে তাঁর মনেও যে গোপন কথাটি দানা বেঁধে উঠেছিল, সেটি হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারতের লেনদেন সম্ভব।’ সেদিন শেখ মুজিবের পরনে ছিল লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে পাঞ্জাবি ও চাদর। শেখ মুজিবকে তিনি বললেন, এই অধমের সঙ্গে আপনি কেন দেখা করতে চাইলেন? কেন ডাকলেন? তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। আমি প্রশ্ন করলাম, গণতন্ত্রের জন্য কি ভারতের কাছে সাহায্য চান? তিনি কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, না। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করলেও আমি পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে যেটির কথা চিন্তা করছি, সেটি শুনলে চমকে উঠবে না তো? শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি তখন বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছি। শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি শুধু চমকেই যাইনি, রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যদি জানে মেরে ফেলবে। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা প্রকাশ হবে না তো! প্রকাশ হলে দেশদ্রোহী মামলা হবে। সাবধান, এভাবে ওপেন বলবেন না। আপনাদের প্রাণ তো যাবেই; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকুন, আমার তরফ থেকে এটি ফাঁস হবে না। মুজিব বললেন, তাদের তরফ থেকেও ফাঁস হবে না। ব্যানার্জি বলেন, সেদিন এই দুই মহান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাঁদের কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি মানসিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নেহেরু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি দেখে যেতে না পারলেও বিশ্বাস করতেন একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখেন। আর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর অবলোকন করেছেন, একজন সাহসী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তাঁর জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে কীভাবে ত্বরান্বিত করে তাঁর দলকে জনপ্রিয় ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথে সফলভাবে ইতি টেনেছেন।

কেবল শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির বক্তব্যেই নয়, এ দেশের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বীর গোয়েন্দা নথি সবখানেই স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামই উচ্চারিত হয়েছে।
আমির হোসেন আমুর কাছ থেকে জানা যায়, সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৫ দলের বৈঠক বিভিন্ন দলের অফিসে বা নেতাদের বাসায় হতো। সেই সময় একটি বৈঠক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ কার্যালয়ে হয়েছিল। বৈঠকের একপর্যায়ে বিরতিকালে পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাকে ন্যাপ সভাপতি ও মুজিবনগর সরকারের আরেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফ্ফরের কক্ষে নিয়ে যান। সেই সময় অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদও তাকে বলেছেন, “তোমাদের নেতা শেখ মুজিব কোনো দিন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা যখন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করতে বসলাম তখন তিনি আমার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দেন। তাতে লেখা ছিল, ‘যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে এবং পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা করবে তাদের কমিটিতে রাখা যাবে না’।
আমির হোসেন আমু বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে পূর্ববাংলা ষড়যন্ত্রের শিকার হলো। দেশ ভাগ করে ব্রিটিশরা যখন চলে যাবে বলে আলোচনা শুরু হলো, তখন ১৯৪০ সালে লাহোর বৈঠকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক অখ- বাংলা নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিলে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীতে ’৪২ সালে আবার মুসলিম লীগ নেতারা এটা পরিবর্তন করেন। ’৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে ভোট হলে পাঁচটি প্রদেশের চারটি পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, ফ্রন্টইয়ার, সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ হেরে যায়। একমাত্র বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। আর অন্যখানে অন্যরা সরকার গঠন করে। বাংলা ভাগ করে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রেস কনফারেন্স করে বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে পূর্ব পাকিস্তানের অংশকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করল। আর পাকিস্তানিরা তাদের সেই ষড়যন্ত্র থেকে বুঝতে পারল সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী থাকলে আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তাই পরে তারা তাকে বাদ দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিল।
আমির হোসেন আমু বলেন, সেই সময়কার পরিস্থিতি এখন বসে ভাবলে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে তখন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। ইসলাম, জিন্নাহ, পাকিস্তান, মুসলমান তখন একাকার। এ অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে দেওয়া দুঃসাহসিক লড়াই ছিল, যা সাদামাঠাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ খুব সহজেই স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আসার সংগ্রাম যে কতটা কঠিন ছিল তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যে লড়াই শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি কেবল বুঝেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে যে সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর লড়াই জনগণের মধ্যে চেতনার বারুদ জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল অসাধ্য সাধন। সেটি তিনি করেছেন।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মণি যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তখন তিনি ’৬২-এর হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবদুর রাজ্জাক যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রচারে ছাত্রলীগের কর্মীদের মাঠে-ময়দানে কাজে লাগিয়েছেন। আবদুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী যখন ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও তোফায়েল আহমেদ ডাকসুর ভিপি তখন তারা ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ ১১ দফার ছাত্র-গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন। সেই গণঅভ্যুত্থানে আগরতলা বা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব মামলা থেকে ৩৮ মাসের কারাবরণ শেষে সব রাজবন্দীসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করে জনগণের মাঝে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ান মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ আমাকে বলেছেন, ৭ জুন হরতালের সিদ্ধান্ত, বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি এবং কতিপয় প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবিতে ২০ মে ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ঘোষণা করা হয়। দেশব্যাপী সেই হরতাল বাস্তবায়নে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে সব ছাত্রনেতা মাঠে কাজ করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তিনি তখন তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমান জহুরুল হক হলের ভিপি ও মাঠের কর্মী। ৭ জুনের হরতালে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকেই তখন রাজপথে ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মণি সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রক্টর ছিলেন ড. ওদুদুর রহমান। তিনি শেখ মণিকে বললেন, ‘মণি! তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাস থেকে চলে যাও। তুমি না গেলে আমার চাকরি যাবে।’ শেখ মণি তখন বিনয়ের সঙ্গে হরতালের কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন। সেদিনের হরতালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তেজগাঁওয়ের শ্রমিক মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদ হন এবং ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়। সেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হরতালকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে দমন-পীড়ন চালায়।
তোফায়েল আহমেদের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি সংবলিত ‘ম্যাগনাকার্টা’খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী গ্রহণ না করায় বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে ১১ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভায় ছয় দফাকে নতুন দিগন্তের মুক্তিসনদ হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে বীর চট্টলের বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিল। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের কাউন্সিল সামনে রেখে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি একের পর এক জনসভা শুরু করেন। ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় এবং তার প্রচার চালানো হয়।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ছয় দফার প্রচার সমর্থন ও জনমত গঠনে দৈনিক ইত্তেফাক ও তার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অসীম সাহসী ভূমিকা রাখেন, যা গোটা দেশবাসী জানে। এখনো সেই সময়ের দৈনিক ইত্তেফাক খুললেই ছয় দফাসহ বঙ্গবন্ধুর একেকটি জনসভা ইত্তেফাক আট কলামে ব্যানার লিড করেছে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণকে ছয় দফার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ, উত্তাল করেছে। আর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে যেমন জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি ইত্তেফাককে ছয় দফা প্রচারের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মুখপত্রে পরিণত করেছিলেন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।