বিভীষিকার কালরাত্রি ছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ, মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতায় খুন হয়ে যায এদেশের শত সহস্র মানুষ। তমসাচ্ছন্ন এই রাত্রিটি মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে স্মরণ করার কর্মসূচি ছিল, কিন্তু তা বাতিল করা হয়েছে আতঙ্ক জাগানিয়া করোনা পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু বাঙালির মনন থেকে তো এ রাতে তৈরি হওয়া ক্ষতগুলো মুছে যাওয়ার মতো নয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনার ঝুঁকি এড়াতে ঘরে বসেই জাতিকে স্মরণ করতে হচ্ছে ২৫ মার্চের কালো স্মৃতিকে।
কেবল বাঙালি জাতির নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর রাত ২৫ ছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ । জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে। ১৯৭১ সালের এ দিনে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত অভিযানে এই রাতে হত্যা করা হয় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ, এই তালবাহানায় গর্জে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার একটি দিক-নির্দেশনামূলক রূপরেখা পেশ করেন। যা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র। আলোচনার নামে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে।
ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। কালবিলম্ব না করে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট বিমানে করে পাড়ি দেন করাচি, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে যান তিনি। ঢাকা ছাড়ার আগে জেনারেল ইয়াহিয়া পাক সেনাবাহিনীকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে যান। এর কয়েক ঘণ্টা না যেতেই পাক হানাদার বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা শহরে।
রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত এলাকায় আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টার নিয়ে নীলক্ষেতসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। রাতভর চলে হত্যাযজ্ঞ।
সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে দেশে শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। নয় মাস সংগ্রামের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্জিত হয় কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার, নয় মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে।
প্রতিবছর এ দিনটি গণহত্যা দিবস পালন করে জাতি। দিনটি ঘিরে থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ কর। এবারও ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে পরিস্থিতি। করোনা সংক্রমণ এড়াতে সব সমাবেশ অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। এবার ঘরে বসেই স্মরণ করতে হচ্ছে, ভয়াল রাত্রির টুকরো টুকরো স্মৃতি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।