নির্বাচন সামনে রেখে আগামী বাজেটে গরিব জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক সুরক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেবে সরকার। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ‘উপকারভোগী’ ও মাসিক ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, নতুন করে আরও ৬ লাখ সুবিধাভোগীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা হচ্ছে। বর্তমানে এ সংখ্যা ৫১ লাখ। এ ছাড়া বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীনসহ সব ধরনের ভাতা বাড়ছে বর্তমানের চেয়ে অতিরিক্ত ১০০ টাকা করে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক সম্মানী ভাতার পাশাপাশি দুটি ঈদে উৎসব ভাতা পাবেন। আগামী বাজেট থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাতা দেওয়া হবে, যাতে সহজে ও দ্রুততম সময়ে এ সুবিধা পেতে পারেন সুবিধাভোগীরা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্তমানে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আড়াই শতাংশ। আগামী বাজেটে এ বরাদ্দ বাড়িয়ে সাড়ে ৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ৩ কোটি গরিব জনগণকে পর্যায়ক্রমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা। এ জন্য প্রণয়ন করা
হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র, যা দুই বছর আগে থেকে কার্যকর। এ লক্ষ্য অর্জনে নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেকে বলছেন, বর্তমানে জীবনযাত্রার ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। সে অনুপাতে সরকারের দেওয়া ভাতার পরিমাণ বাস্তবসম্মত নয়। এ জন্য চলমান সামাজিক কর্মসূূচিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে অর্থাৎ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করেছিল। পরবর্তীকালে সব সরকার জনবান্ধব এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। কিন্তু পদ্ধতিগত দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে এর সুফল পুরোপুরি মিলছে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতি বছর এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও এর সুফল উপকারভোগী বা টার্গেট গ্রুপের কাছে তেমন পেঁৗছে না। বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক, বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বিদ্যমান কর্মসূচি পর্যালোচনা করে যোগ্যদের কাছে তার সুবিধা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ডাটা ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে। এখানে সব উপকারভোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৮০ ভাগ তথ্য সংরক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো কাজ সম্পন্ন হলে তখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে মাসিক ভাতা পেঁৗছানো যাবে। তাদের আর এ বাবদে ব্যাংকে যেতে হবে না। আশা করা যাচ্ছে, আগামী বাজেটের পর এটি চালু করা হবে।
ভাতা ও আওতা বাড়ছে :জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বর্তমানে বয়স্কভাতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। সারাদেশে এখন মাসিক ৫শ’ টাকা করে বয়স্কভাতা পাচ্ছেন ৩১ লাখ ৫০ হাজার জন। আসন্ন বাজেটে এর সঙ্গে আরও যুক্ত হচ্ছে অতিরিক্ত সাড়ে তিন লাখ মানুষ। ভাতা পাবেন ৬শ’ টাকা করে। সামাজিক নিরাপত্তার আরেকটি বড় কর্মসূচি হচ্ছে বিধবা ভাতা। এখন সারাদেশে বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ১১ লাখ ৫০ হাজার জন। নতুন বাজেটে মোট ১২ লাখ ৬৫ হাজার বিধবাকে এর আওতায় আনা হচ্ছে। ভাতা দেওয়া হবে ৬শ’ টাকা, যা এখন আছে ৫শ’ টাকা। বর্তমানে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন সাড়ে সাত লাখ মানুষ। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ৭৫ হাজার। ভাতা ৬শ’ থেকে বাড়িয়ে ৭শ’ টাকা দেওয়া হবে।
অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা ভাতা চালু করেছে বর্তমান সরকার। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয় যথাক্রমে ৫শ’, ৬শ’, ৭শ’ ও ১২শ’ টাকা করে। সূত্র জানায়, এ সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তবে ভাতা অপরিবর্তিত থাকবে। এর বাইরে হিজড়া, দলিত হরিজন, বেদে শ্রেণি, দরিদ্র ক্যান্সার রোগী ও চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে সরকার। আসন্ন বাজেটে তাদের ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। এখন একজন বেদে মাসিক ভাতা পাচ্ছেন ৫শ’ টাকা। তাকে দেওয়া হবে ৬শ’ টাকা। সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার বেদে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় রয়েছে। নতুন বাজেটে এ সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হচ্ছে। এ ছাড়া হিজড়ারা পাবেন ৭শ’ টাকা, যা এখন আছে ৬শ’ টাকা। সাড়ে সাত হাজার হিজড়া বর্তমানে মাসিক আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। এ সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে আরও ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আর্থিক সুবিধা চালু করা হয়। প্রত্যেক চা শ্রমিককে এককালীন ৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। এবার ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, আগামী বাজেটে এ বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হচ্ছে।
উলি্লখিত ভাতা তদারকি করে থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আরও অনেক ভাতা চালু আছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে ১৪৩টি সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন। এতে মোট বরাদ্দ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের সাড়ে ১৩ ভাগ। সূত্র জানায়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় বড় কর্মসূচি চালু আছে। এটি হলো মাতৃত্বকালীন ভাতা। বর্তমানে সারাদেশে ৫ লাখ মানুষকে এর আওতায় আনা হয়েছে। আসন্ন বাজেটে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৬ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। মাসিক ভাতা দেওয়া হবে ৭শ’ টাকা করে, যা এখন আছে ৬শ’ টাকা। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ভাতা চালু রয়েছে। এখন ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী পাচ্ছেন। সূত্র জানায়, নতুন বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও সংখ্যা বাড়বে না। তবে বাড়তি সুবিধা হিসেবে দুটি ঈদে সমপরিমাণ উৎসব ভাতা দেওয়া হবে তাদের। এ ছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ, শিক্ষাবৃত্তি, ওএমএসসহ চলমান অন্যান্য কর্মসূচি অব্যাহত থাকছে আগামী বাজেটে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।