বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বৃদ্ধি পেতে চলেছে। আগামী এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের সময় এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সমঝোতা স্মারক সই হবে। আপাতত দুই দেশের মধ্যে তার রূপরেখা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
এপ্রিল মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ সফরে শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আমন্ত্রণে নৈশভোজে যোগ দেবেন। মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান জ্ঞাপন করবেন। এ ছাড়া তিনি রাজস্থানে আজমির শরিফে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী, সহযোগিতার এ ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। অনুচুক্তি বা সমঝোতা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে যৌথ সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি হবে। এ ছাড়া সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ আরও নিবিড় করা হবে। বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির আরও বাড়ানো হবে। দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে। বাংলাদেশের জন্য সামরিক নৌযান নির্মাণেও ভারত সাহায্য করবে।
সহযোগিতার চরিত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে অবশ্য এখনো কিছু কিছু বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পক্ষে হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দরুন বাংলাদেশ তেমন কিছু চায় না। এমনকি ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ শব্দযুগল নিয়েও বাংলাদেশের আপত্তি রয়েছে। বিষয়টিকে তারা বরং সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী। দেশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ এমন কোনো ধারণার সৃষ্টি করতে চায় না যে দেশটি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশ সফরের সময় এই সুসংহত চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের সফরের সময় বিষয়টিকে সমঝোতা স্মারকের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। যৌথ সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য কোন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করা হবে, সে বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের একটি সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ভারতীয় নেতৃত্বকে বাংলাদেশ বারবার এটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে, একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তারা সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তার করবে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় হতে চায় না।
শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা পানি চুক্তি নিয়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। না হওয়ার কারণ একটাই। ২০১১ সালের পর থেকে এ বিষয়ে ভারত সরকার এক পা-ও এগোতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে বিজেপি নেতৃত্ব এখনো অর্থবহ আলোচনা করে উঠতে পারেনি। ইতিমধ্যে কেন্দ্র-রাজ্যের সস্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে।
তিস্তার স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে ভারত অবহিত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র এ বিষয়ে জানায়, তিস্তা নিয়ে এখনো এগোনো যায়নি, এর অর্থ এই নয় যে আগামী দিনে এর মীমাংসা হবে না। বরং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার অভিন্ন নদীগুলোর অববাহিকার যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন, ভারত তা ইতিবাচক মনে করে। শীর্ষ বৈঠকে এ নিয়ে কিছু অগ্রগতির আশা করা যায়। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে যাঁরা একমাত্রিক মনে করেন, তাঁরা ভুল করবেন। এ সম্পর্ক তিস্তার মতো কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়।
তিস্তা চুক্তির মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘গঙ্গা ব্যারাজ’। বাংলাদেশ এ বিষয়েও ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা প্রত্যাশী। এ নিয়েও অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যেমন রয়েছে ভারতেরও। তবে এ নিয়ে শেখ হাসিনার সফরে কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের মালিকানাধীন অন্যতম গণমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত করাই এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের মূল বিষয়। গত নভেম্বরে চীন থেকে বাংলাদেশের দুটি সাবমেরিন কেনার ঘটনা ভারতের অনেককে চমকে দিয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকে ভারতীয় সেসব সমরাস্ত্র কিনতে চান না, যা তাঁরা অন্য দেশ থেকে কিনছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়ার পর ঢাকার ওপর বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দিল্লির। ভারত মহাসাগরে কৌশলগত সামরিক উপস্থিতির জন্য চীনের স্ট্রিং অব পার্লসে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
এ সব প্রসঙ্গের অবতারণা করে সম্প্রতি ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও হিন্দুস্তান টাইমস এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রচার করেছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।