ইউরোপের ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র বাঙলা তরজমাই কেবল করেন নি তিনি। সেই ভালোবাসা দিবসকে বাংলাদেশে প্রচলন করেছেন। প্রথমে ছোট্ট পরিবেশে ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি এ দিনটি পালন করতেন। খুব চেনাজানা পরিসরের অল্প কিছু তরুণ-তরুণী তাতে শামিল হতেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিতিরা আসতেন খুব কম। এছাড়া তিনি ভালোবাসা দিবস নিয়ে কাগজে লিখতেন। ক্যাম্পেইন করতেন টেলিভিশনে নিজের করা অনুষ্ঠানে। তখন তো একটাই টিভি। টেরেস্ট্রিয়াল। রাষ্ট্রীয় মালিকানার। স্যাট চ্যানেলের এতো ছড়াছড়ির কথা ভাবাই যেতো না।
অর্থাৎ পুরোই রক্ষণশীল ও কঠোর কানুন নিয়ন্ত্রিত একটা সমাজ। ভালোবাসা শব্দটাই খুব স্পর্শকাতর লোকসমাজে। উচ্চারণ করতেই বাধো বাধো ঠেকে। গুরুজনের সামনে বলাই যায় না। ভালোবাসার কথা বললে বেলেল্লা বেহায়া বলে গালমন্দ শুনতে হয়। চারদিকে রক্তচোখের এমন ভ্রুকুটির মধ্যে রংচঙে প্রিন্টের শার্ট আর উজ্জ্বল রঙ্গিন টাই ও দামি স্যুট পরা সাহেবি কেতাদুরস্ত এক বিলেত ফেরত বাংলাদেশী প্রৌঢ় মানুষ যখন ভালোবাসার কথা বলতে শুরু করেন, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলেন তখন চারদিকেই ছিঃ ছিঃ রব উঠেছিল। সমর্থন দূরে থাকুক নিন্দাবাদের প্রতিযোগিতার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মোল্লা-মৌলভি সাহেবানরা তো বটেই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত একে অপসংস্কৃতি ও ভিনদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে ক্রমাগত তির ছুঁড়েছে তার বিরুদ্ধে। এখন সেটা নেই। ভালোবাসা দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বসন্তকালের এই দিনটি ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ মানুষেরা পরম উচ্ছ্বাস ভরে উদযাপন করছেন। ফুল পোশাকের বর্ণাঢ্যতায় বর্ণীল হয়ে উঠছে নগরজীবন। গ্রামীন সমাজেও এর ছোঁয়া লেগেছে। পত্রিকাগুলো পয়লা পাতায় ছাপছে ভালোবাসা দিবস উদযাপনের সচিত্র রিপোর্ট। টিভি চ্যানেলগুলো এই দিনে আলেখ্য অনুষ্ঠান ও রিপোর্ট করছে। নিউজ পোর্টালগুলোও বাদ থাকছে না।
এই যে পত্রে-পুষ্পে-পল্লবে, পোশাকে-উপহারে-অনুষ্ঠানে, রঙে-রূপে-বিনিময়ে ভালোবাসার এত আলোড়ন ও আয়োজন এর প্রবর্তক শফিক রেহমান।
একজন হিশেববিদ, সাংবাদিক, রেডিও-টিভির উপস্থাপক-সঞ্চালক, গল্পকার, লেখক, মুভি ক্যাম্পেইনার ও বাদনশিল্পী তিনি। সাংবাদিকতায় যশস্বী হয়েছেন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক দুই মাধ্যমেই। অনেক গুণাবলী তার। তবে বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন নিউজপ্রিন্টে ছাপা সাদাকালো একটা শীর্ণ ময়লা পত্রিকা বের করে। যায়যায়দিন। এই চটি পত্রিকাটি বনেদি পাঠকদের উপর নির্ভরশীল হয়নি। কেবল ভাষা, উপস্থাপন ভঙ্গি ও বিষয়বস্তুর গুণে অসংখ্য অগণিত সদ্য কৈশর পেরুনো তরুণ তরুণী এর পাঠক হয়ে ওঠে।
পত্রিকার এই বিশাল নতুন পাঠকগোষ্ঠী সৃষ্টি তার অতুলনীয় সাফল্য। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভাষা, রুচি ও বিষয়বস্তুকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে তাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন শফিক রেহমান মূলত: তার যায়যায়দিন পত্রিকার মাধ্যমে। আজকের সংবাদপত্রের পাঠক রুচিকে আমরা নির্দ্বিধায় শফিক রেহমানের সৃষ্টি বলতে পারি। আজকের এই পাঠক জেনারেশনকে যায়যায়দিন প্রজন্ম বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। তবে একই সংগে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, বানান রীতির সংস্কার ও নতুন ধাঁচের দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের প্রকল্প একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছে। এটা কতটা তাঁর নিজের ব্যর্থতা আর কতটা তাঁর টিম সিলেকশনের ভুল তা নিয়ে তর্ক করা যায়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা শফিক রেহমান পরম কোমল একজন ভালোবাসার মানুষ। তিনি মানুষ, স্বদেশ, প্রকৃতি, নিসর্গ ও শিল্পকে ভালোবাসেন প্রবলভাবে। দেখতে চান একটি ভালোবাসায় মোড়া সমাজ ও দেশ। যেখানে থাকবেনা হিংসা-হানাহানি। থাকবেনা শোষণ-বঞ্চনা-উৎপীড়ন-দুঃশাসন। মানুষকে ভালোবেসে তাদেরকে স্বমহিমায়, স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চান তিনি। চান তাদের অধিকারের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা।
অপরাধের বিচারের সংগে অপরাধীর সাজা সংশোধনমূলক হোক এটাই তাঁর আকাঙ্ক্ষা। তাই তিনি নিষ্ঠুর প্রাণদণ্ডের বিলোপ চান বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব থেকে। তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের তিরে তিনি বিদ্ধ করেন দুঃশাসনকে। তাই এরশাদের স্বৈরশাসনামলে তিনি এবং যায়যায়দিন স্বদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে এই আমলে তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে কারানির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এখনো তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে সেই অবিশ্বাস্য মামলার খড়গ।
তবুও ভালোবাসার বাণী নিয়ে এই বিশ্বনাগরিক পথ হাঁটছেন বাংলাদেশের প্রান্তরে। বিরাশি পেরিতে তিরাশিতে পা রাখছেন। ১১ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। অফুরন্ত শুভেচ্ছা শফিক ভাই। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন, শতায়ু হোন।আপনি অস্তাচলে পৌঁছে এখনো আমাদের আকাশে ভালোবাসার আবীর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আপনার প্রত্যাশার কিরণ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। থেমে যাক উৎপীড়িতের কান্নার রোল। বাংলাদেশ হোক ভালোবাসায় মোড়া। ভালোবাসার ফেরিওয়ালাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
সৌজন্যে : বিডিসংবাদ
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।