নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলেও আইন লঙ্ঘনকারী বা ভেজালকারীদের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। অপরাধ করে ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের আরো কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আইনজ্ঞরা বলছেন, হাইকোর্টের রায়ের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকাজ ছাড়া বাকি সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। তাঁরা আগের মতোই তাত্ক্ষণিক অভিযানও চালাতে পারবেন। সরকার ইচ্ছা করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারবে।
আইনজীবীদের মতে, হাইকোর্টের রায়ের পর হাতেনাতে ধরা পড়া অপরাধীদের তত্ক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়ার পথ রুদ্ধ হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এতে অপরাধীদের ধরতে কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাত্ক্ষণিক বিচার না করতে পারলেও খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যে ভেজালকারীদের কারখানা সিলগালা বা বন্ধ করতে পারবেন। এমনকি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট আইনে আসামির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করবেন এবং আসামিকে থানায় সোপর্দ করবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
আইনজীবীরা উদাহরণ দিয়ে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; যদিও বাস্তবে এই আইনে মামলা হলে আসামির যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালত উঠে গেলে অপরাধীদের আরো কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তাঁদের মতে, নিরাপদ খাদ্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধিসহ বিভিন্ন আইনে ওই অপরাধীদের শায়েস্তা করা সম্ভব।
হাইকোর্ট গত ১১ মে এক রায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনাসংক্রান্ত ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে এই আইনের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের সদস্য দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হতে হবে।
আইনজীবীদের মতে, হাইকোর্টের রায়ের প্রভাব পড়বে দণ্ডবিধির ৪৯টি ধারা এবং অপর ৯৭টি আইনের ওপর। অপরাধীদের মূল আইনে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধরে আদালতে সোপর্দ করলে প্রচলিত নিয়মে বিচার হবে। হাইকোর্টের ওই রায়ের পরও খাদ্যে ভেজাল, ইভ টিজিং, অবৈধ দখল, মাদক কারবার, ভেজাল ওষুধ বিক্রি, বাল্যবিবাহ, বন্য প্রাণী বিক্রি, পরীক্ষাকেন্দ্রে নকল সরবরাহসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে সব কিছু নির্ভর করছে সরকারের আন্তরিকতার ওপর। সরকার চাইলে অপরাধ দমনে আগের মতোই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান চালাতে পারবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারবে।
এদিকে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ আজ রবিবার আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু কালের কণ্ঠকে বলেন, পবিত্র রমজান আসন্ন। হাইকোর্টের রায়ের পর জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রমজানে ভেজালমুক্ত খাবার তাঁরা খেতে পারবেন কি না, এটা নিয়েই আশঙ্কা। কারণ অতীতে রমজানে ভেজালকারীদের ধরতে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাত্ক্ষণিকভাবে অপরাধ দমনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হতো। মানুষ ভেজালমুক্ত খাবার খেতে চায়; কিন্তু এ রায়ে সেটা বাধাগ্রস্ত হবে। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকলে ভ্রাম্যমাণ আদালত হিসেবে আর কোনো কাজ করা যাবে না। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রমজানে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা অপরাধীকে আটক করার পর থানায় সোপর্দ করবেন এবং মামলা করবেন। এরপর বিচার হবে সাধারণ আদালতে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকায় জনমনে স্বস্তি ছিল। অপরাধীদের মধ্যে আতঙ্কের নাম ছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। তিনি বলেন, প্রতিটি আইন সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো সমাজ ও জনগণের শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা দেওয়া। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হবে আপিল বিভাগে। আদালতকে রাষ্ট্রের বাস্তব প্রেক্ষাপট বোঝানোর চেষ্টা করা হবে।
ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের পর জনমনে একটি ভুল বার্তা যেতে পারে। ভ্রাম্যমাণ আদালত আর পরিচালিত হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। মনে রাখতে হবে, আদালত পুরো আইনটি বাতিল করেননি। আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল করেছেন। মোটা দাগে বলতে গেলে, আগের মতো আর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না। আদালত বলতে যেটা বোঝায় তা করা যাবে না। এ রায়ে তাড়াহুড়ার বিচার বন্ধ হয়েছে। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আগের মতোই অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। ’
ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম আরো বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর সব কিছু নির্ভর করছে সরকারের আন্তরিকতার ওপর। সরকার চাইলে অপরাধ দমনে আগের মতোই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান চালাতে পারবে, যেমনটি ২০০৭ সালের আগে হতো। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হলে সরকারকে সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইন সংশোধন করতে হবে অথবা নতুন করে আইন তৈরি করতে হবে।
পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথম দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত খুব জনপ্রিয় ছিল। কারণ এই আদালতে অপরাধের তাত্ক্ষণিক সাজা হতো। কিন্তু এই আইনের কিছু অপব্যবহারের কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা হাইকোর্টে আবেদন করেন। আর হাইকোর্ট তা বাতিল করেন। তবে এটা বাতিল হলেও অপরাধ দমনে সমস্যা হবে না। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, খাদ্যে ভেজালের জন্য নিরাপদ খাদ্য আইন ছাড়াও বিশেষ ক্ষমতা আইন, দণ্ডবিধি আইনসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন আইনে অপরাধীদের বিচার করা যাবে। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগের মতো আসামি ধরে আদালতে সোপর্দ করবেন। আদালতে তাদের বিচার হবে।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, এখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। সরকার আন্তরিক হলে দ্রুত এই আইন সংশোধন করতে পারে অথবা নতুন করে আইন করতে পারে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ার : বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির ৪৯টি ধারার অপরাধ, জুয়া আইন, মাদক সেবন আইন, টাউট আইন, হকার আইন, রেলওয়ে আইন, বিদ্যুৎ আইন, বন্দর আইন, সিনেমাটোগ্রাফ আইন, পশুর প্রতি নির্দয় আইন, পাসপোর্ট আইন, ক্যান্টনমেন্ট আইন, হাইওয়ে আইন, বাল্যবিবাহ আইন, মোটরযান অধ্যাদেশ, ভবঘুরে আইন, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ইমারত আইন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আইন, ইট পোড়ানো আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের কতিপয় ধারা, পাবলিক পরীক্ষা আইন, ইভ টিজিং, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, মত্স্য ও হ্যাচারি আইন, গ্যাস আইনসহ মোট ৯৮টি আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য মোবাইল কোর্ট আইন করা হয়।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকারী হইবেন। ’ কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত সরকার নিয়ন্ত্রিত। ২০০৭ সালে সরকার আমলাদের সন্তুষ্ট করে ‘মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট’ অধ্যাদেশ জারি করে। পরে ২০০০ সালে আইন হয়। প্রথম দিকে জরিমানা আদায় করার ক্ষমতা দেওয়া হয় মোবাইল কোর্টকে। পরে সর্বোচ্চ দুই বছরের শাস্তির বিধান করা হয়।
মানুষের দোরগোড়ায় বিচারকাজ নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই ২০০৯ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আসছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এতে বিচারপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। প্রথম থেকে এই আদালতের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক ওঠে।
হাইকোর্টের রায় : ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত তিন ব্যক্তির দাখিল করা আলাদা তিনটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৫, ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯, ১০, ১১, ১৩ ও ১৫ নম্বর ধারা সংবিধানের ২২, ২৭, ৩১ ও ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ পরিপন্থী। এটা সংবিধানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানের দুটি মৌলিক কাঠামো, বিশেষ করে প্রজাতন্ত্রের তিনটি অঙ্গের (নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ ও বিচার বিভাগ) মধ্যে ক্ষমতা পৃথক্করণ সংক্রান্ত নীতির পরিপন্থী। এ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ধারাগুলো সংবিধানের ওপর আঘাত। এই আইন বিচার বিভাগ পৃথক্করণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।