কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ নাগরিকত্ব আইনের মারপ্যাঁচ ও বিভিন্ন সময়ে হওয়া চুক্তিগুলোর দোহাই দিয়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করতে পারে মিয়ানমার বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আইন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোনও কর্মপরিকল্পনা না করে কেবল ‘ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত’ বলাটা সময় ক্ষেপণ ছাড়া কিছু না। এরকম জরুরি পরিস্থিতিতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অর্থবহ করতে চাইলে ওই সভাতেই এর কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা জরুরি ছিল। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে বললেও অতীতের শর্তারোপের ধরণ ও সম্প্রতি সূ চি’র বক্তব্য থেকে আশান্বিত হওয়ার জায়গা কম। শক্তিশালী কৌশলী কূটনীতিই পারে সেই আশা জাগাতে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে গত সোমবার ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার ভিত্তিতেই রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’র ১৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন তার দফতরের মন্ত্রী। সু চি’র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যাচাই ও প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত রয়েছে। ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ঘোষণা অনুসারে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
সম্প্রতি বৈধ কাগজপত্রহীন রোহিঙ্গাদের ‘নাগরিকত্ব’ প্রশ্নে নেতিবাচক অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষরা দেশে ফিরতে গেলে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তালিকা দিতে পারে। কিন্তু ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভেরিফিকেশনের নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমারের হাতে থাকবে।
মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে, এ আইন কার্যকর হওয়ার আগে যাদের নাগরিকত্ব ছিল, তাদের নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। ১৯৮৯ সালে পুরো মিয়ানমারে নাগরিকত্ব নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া চালানো হয়। যারা নতুন শর্তাবলী পূরণ করতে পারছে বলে মনে হয়েছে, তাদের ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি) বদলে সিটিজেনশিপ স্ক্রুটিনি কার্ড (সিএসসি) দেওয়া হয়।
রাখাইনের যেসব মুসলিমের পরিচায়ক নথিপত্র ছিল না তাদের এবং ফেরত আসা শরণার্থীদের জন্য ১৯৯৫ সালে কর্তৃপক্ষ টেম্পোরারি রেসিডেন্সি কার্ড (টিআরসি) ইস্যু করতে শুরু করে।২০১৫ সালের শুরুর দিকে সরকার সব টিআরসি বাতিল ঘোষণা করে এবং সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনাল টিআরসিধারীদের ভোটদানে অযোগ্য ঘোষণা করে। এ পরিস্থিতি তৈরিই করা হয়েছে এদের অস্বীকার করার জন্য উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার মনে করেন, মিয়ানমারের শর্ত এবং আলোচনার ধরনে আশ্বস্ত হওয়ার তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেননা, তারা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া জুড়ে দিয়েছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে জীবনের ভয়ে পালিয়ে আসা লোকদের কোন ধরনের কাগজপত্র থাকবে, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এই ভেরিফিকেশন বলতে তারা যখনই বৈধ কাগজপত্রের কথা বলবে, তখনই তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেননা, তাদের সঙ্গে এসব থাকবে না। রাখাইনের এই মানুষদের মিয়ানমার অস্বীকার করার কারণে সাময়িক যে কার্ড ছিল, সেটাও কেড়ে নিয়েছে। সেই মানুষটি কী নিয়ে ফেরত যাওয়ার তালিকায় উঠবে।’
কী উপায়ে ফেরত পাঠনো সম্ভব জানতে চাইলে সি আর আবরার আরও বলেন, ‘ঠিকানা জেনে, পরিবার বংশ চিনে গ্রহণযোগ্যভাবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এই মাপকাঠি যদি উঁচু রাখা হয় এবং দলিল দস্তাবেজের ওপর নির্ভর করে হয়, তাহলে একটা লোকও ফেরত যেতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা তো ওখান থেকে এক-একজন করে পাঠায়নি। এটা গণহারে দেশত্যাগে বাধ্য করা। ফলে ফেরানোর প্রক্রিয়াটি দালিলিক না হয়ে টেকনিক্যালি করতে হবে। কোনও কর্মপরিকল্পনা না করে কেবল ‘ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত’ বলাটা কালক্ষেপণ ছাড়া কিছু না। এরকম জরুরি পরিস্থিতিতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ মিনিংফুল করতে চাইলে ওই সভাতেই এর কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা জরুরি ছিল। এমনকি পরবর্তী সভা কবে হবে, সেই সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ না করাটাও শঙ্কার।’
একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খানও মনে করেন, যখনই ১৯৯২ সালের চুক্তি মেনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বলা হবে, তখনই বিষয়টি প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠবে। তিনি মনে করেন, ‘১৯৯২ সালের চুক্তি মোতাবেক ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত’ এটি মিয়ানমারের একটি ফাঁদ। তারা আসলে জানে এই শর্তে একজনও ফেরত যেতে পারবে না।কারণ, এখন যারা এখানে আছেন, তাদের কারও কাছে তাদের (মিয়ানমার সরকারের) শর্ত অনুযায়ী ‘বৈধ কাগজ’ থাকার কোনও কারণ নেই।’ বাংলাদেশের অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত উল্লেখ করে তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি তৃতীয় কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা। রোহিঙ্গাদের ওদিকের (মিয়ানমারের) কাগজ না থাকলেও এদিকের কাগজ হওয়ার পর আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি সামনে আনতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন মনে করেন, রোহিঙ্গারা কতদিন থাকবে, কিংবা তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে- এসব বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। তেমনি কিভাবে তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করানো যায়, সেটা ঠিক করতে পারাও কম জরুরি নয়। মিয়ানমার কখনও স্পষ্ট করে কোনও কথা বলেনি। তারা এর আগে সাত হাজারের একটা তালিকার কথা উল্লেখ করতো। এবার পুরো বিশ্ব দেখেছে কোন পরিস্থিতিতে লাখ লাখ মানুষ কাদাজল পার হয়ে এপারে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কাছে আপনি কিসের কাগজ চাইবেন। ফলে এই শর্ত জুড়ে দিয়ে তারা আসলে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।