প্রতারণার অপর নাম হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং। অর্থ লেনদেনের এ মাধ্যম ব্যবহার করে একশ্রেণীর অসাধু চক্র অবাধে বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। হুন্ডি বা অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়নে এই মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। চাঁদাবাজি, প্রতারণার অর্থ এবং ঘুষের টাকা লেনদেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চলছে হরহামেশাই। ফলে মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২৮টি ব্যাংক এ সেবার অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ব্যাংক এ সেবা চালু করেছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করলেও এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। বর্তমানে মোট লেনদেনের সিংহভাগই বিকাশের মাধ্যমে হচ্ছে।
তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের গ্রাহক সংখ্যা চার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যার মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে ৭৭৩ কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইলের মাধ্যমে খুব সহজেই অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় হরহামেশাই প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। প্রতারকরা প্রতারণা করতে অধিকাংশ সময় টার্গেট করছে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে। প্রতারণার অংশ হিসেবে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে নানা প্রলোভন। আর এ প্রলোভনে পড়েই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে।
অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সুবিধা দেয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে মোবাইল ফোনটি। মোবাইল ফোন বন্ধ করলেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এজন্য সাময়িক বন্ধ থাকা মোবাইল ব্যবহারকারীর পরিবারকে ফোনে জানানো হচ্ছে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তার চিকিৎসার জন্য দ্রুত টাকা প্রয়োজন। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যরা প্রতারকের কথা বিশ্বাস করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠান। একপর্যায়ে জানতে পারেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আসা অভিযোগে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অপরাধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে ডিনার প্রোগ্রাম, সুলভ মূল্যে ফ্ল্যাট-প্লট প্রদান ও জিনের বাদশার কথা বলে অর্থ আদায়, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, চুরি, হ্যাকিং, ন্যাশনাল আইডি কার্ড জালিয়াতি, সিএনজি ও অটোরিকশা ছিনতাই প্রভৃতি। এসব ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় সন্দেহজনক লেনদেন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালী অঞ্চলে এ ধরনের লেনদেন বেশি হচ্ছে। মানবপাচার থেকে শুরু করে মাদক বেচাকেনায় অর্থায়নও হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করার পক্ষে সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আর্থিক সেবা ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ সংক্রান্ত এক নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে কোনো মোবাইল ব্যাংকিং হিসেবে ৫ হাজার টাকা বা তার বেশি নগদ অর্থ জমা বা উত্তোলনে গ্রাহককে পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ডের ফটোকপি প্রদর্শন করতে হবে, যা এজেন্ট তার রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবেন। রেজিস্টারে গ্রাহকের স্বাক্ষর বা টিপসই সংরক্ষণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনের টাকা উত্তোলনের সীমা ২৫ হাজার থেকে কমিয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে জমা দেয়া যাবে দিনে ১৫ হাজার টাকা। মাসে ১০ বারের বেশি টাকা তোলা যাবে না। এক মাসে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা যাবে। তবে জমা দেয়া যাবে ২০ বার সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা।
এদিকে হুন্ডি ঠেকাতে ব্র্যাক ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের ক্যাশ আউট (অর্থ উত্তোলন) বন্ধ করার দাবি করেছেন ব্যাংকাররা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দেশের শীর্ষ ২০ রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংকের প্রতিনিধিদের বৈঠকে এ দাবি তোলা হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠায় আশঙ্কাজনকহারে প্রবাসী আয় কমে যায়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বৈঠক করে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে গ্রাহকদের সঙ্গে এক প্রকার প্রতারণা হচ্ছে উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ১০০ টাকা লেনদেনের সময় ১ টাকা ৮৬ পয়সা চার্জ হিসেবে কেটে নিচ্ছে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যা প্রায় দুই টাকার সমান। এটা জনগণের সঙ্গে এক প্রকার প্রতারণা। তারা মানুষকে ঠকাচ্ছে। যেখানে ব্যাংক সিস্টেমে নেয় ৪০ পয়সা, সেখানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চার্জ ৪০ পয়সার বেশি হওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে ভেবে দেখতে হবে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অপতৎপরতা ঠেকাতে প্রথমে কেওয়াইসি অর্থাৎ গ্রাহক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে হবে। এছাড়া এর নিয়মনীতির পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ উত্তোলনের সীমা কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা করেছে। এটা আরও নামিয়ে আনা দরকার। একইসঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক সবগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কর্যক্রমে ব্যবহার করতে পারলে অপব্যবহার কিছুটা কমতো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হুন্ডি ও অপব্যবহার রোধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জবাবদিহিতা আরও বাড়াতে ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরিতে নীতিমালা পরিবর্তনের কাজ চলছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।