কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি খুবই বেশি। এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে, অভাব রয়েছে খাবার আর প্রয়োজনীয় ওষুধেরও। যার কারণে ক্যাম্পগুলোতে মহামারি আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে ফরাসি সংবাদ সংস্থার এএফপির খবরে এমনটাই বলা হয়েছে। পরিস্থিতি খুবই সংকটপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং হওয়ায় সংকট মোকাবেলার প্রচেষ্টা আনুপাতিক হারে বাড়ানো হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিছবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে আজও চার জন ভর্তি ছিলেন।’ তবে পরিস্থিতি আপাত নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যদি তারা স্বাস্থ্যকর খাবার না পান, সঠিক স্যানিটশন পদ্ধতি অবলম্বন না করেন এবং সবার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত এক মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে চার হাজার পাঁচ’শ ব্যক্তি এবং মারা গেছে দু’জন। এছাড়াও পোলিও এবং হামের টিকা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার শিশুকে।
এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা নারী রমিজা খাতুন (৩০) জানান, মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত জুটেছে এক বেলা। এর কিছুটা তিনি খেয়েছেন, বাকিটা পাশে বসা দুই সন্তানকে খাইয়ে দিয়েছেন। গত দু’দিন ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে থাকতে তিনি নিজেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন বলেও জানান রমিজা।
জানা গেছে, কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বালুখালী ঢাল পাহাড় পর্যন্ত ছোট বড় ১৭টি পাহাড়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া পালংখালী, থ্যাংখালী ও টেকনাফের উনছিপ্রাং-এর বিভিন্ন পাহাড়েও আশ্রয় নিয়েছে তারা। তাদের সবাইকে এখনও স্যানিটেশনের আওতায় আনা যায়নি। ফলে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব এলাকায় এক হাজার আট’শ টয়লেট এবং ৩০টির মতো নলকূপ বসানো হয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পাহাড় ও টিলায় ছড়িয়ে পড়ায় তাদের সবাইকে এই ব্যবস্থার মধ্যে আনা যাচ্ছে না।
চলতি সপ্তাহে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন ‘বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতৃত্বে ১০ জনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল। সেই দলের সদস্য ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের তিন জন চিকিৎসক। তাদেরই একজন সদস্য ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলেন, ‘পানিবাহিত রোগ, অপুষ্টি, নিউমোনিয়া এবং ত্বকের সংক্রমনে ভুগছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা শিশুরা।
ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলেন, ‘এখানে শতকরা ৮০ শতাংশ শিশু প্রধানত অপুষ্টিতে ভুগছে, কারণ বেশিরভাগ মায়েদেরই ছয় থেকে ১১ জন সন্তান। মায়েরাও অপুষ্টির শিকার বলে তারা বুকের দুধ খাওয়াতে পারছে না। ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে তারা নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর টিকা না দেওয়ার কারণে আক্রান্ত হচ্ছে হামে। এদিকে পানিবাহিত রোগ তো আছেই। নিরাপদ পানি আর সঠিক স্যানিটেশনের অভাবে এসব পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়েছেন ডা. ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে রাখা না গেলে নারী ও শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবেন। চর্মরোগ ছাড়াও জণ্ডিস, জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তারা রোদ-বৃষ্টির মধ্যে থাকছে। নতুন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাচ্ছে, যা তাদের শরীরে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আসছে।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থ্যা ব্র্যাকের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার মাহবুবুল কবীর বলেন, ‘‘ব্র্যাকের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ৩৯২টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে, যার আওতায় পরবে প্রায় এক লাখ মানুষ। অপরদিকে ৩০ হাজার ছয়শ মানুষের ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৭৬৫টি শৌচাগার। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ১৫ হাজার শৌচাগার ও এক হাজার একশ বিশটি টিউবওয়েল বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে ব্র্যাকের। মূলত নারী ও শিশুদের জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, টিউবওয়েল এবং শৌচাগার স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপদ পানি, পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত উপকরণ সরবরাহের চেষ্টা করছে ব্র্যাক।’
ব্র্যাক ইতোমধ্যে ৫৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালুর মাধ্যমে সেবা দিয়েছে ২৫ হাজার ৭০৩ জন রোগীকে। এরমধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর এবং অন্যান্য রোগের সেবা দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৯৯২ জনকে। ২৬০ জনের যক্ষ্মা পরীক্ষা করে ১৭ জনের রোগ শনাক্ত হয়েছে, তবে এক হাজার ৪৫১ জন ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করা হলেও ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘আমরা যদি ঠিকমতো তাদের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তো থেকেই যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা টেকনাফ-উখিয়াতে গিয়েছেন, আরও অনেক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারাও গিয়েছেন। সবাই নিজেদের উদ্যোগে কিছু মোবাইল টয়লেটের ব্যবস্থা করেছেন। যদি এগুলো ঠিকমতো প্রতিস্থাপন করা হয় ও শরণার্থীরা তা ব্যবহার করে তাহলে ঝুঁকি কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের নিজ এলাকাতেও স্বাস্থ্য সচেতন ছিল না, তারা খোলা জায়গায় মল-মূত্র ত্যাগ করতে অভ্যস্ত। তাদের কিন্তু স্বাস্থ্য সর্ম্পকে ন্যূনতম ধারনাও নাই। তাদের স্যানিটারি টয়লেট তৈরি করে দিলেও যে তারা সচেতন হয়ে ব্যবহার করবে-সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে যে কেউ মনিটরিং করবে এতো লোকবলও আমাদের নেই।’
অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা আরও বলেন, ‘এসব কারণেই পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা আছে। একারণে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে ১২ লাখ কলেরা ভ্যাকসিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ভ্যাকসিন পেলে চলমান ইপিআই কার্যক্রমের সঙ্গে কেবল রোহিঙ্গা নয়, ঐ এলাকায় যারা বাংলাদেশী রয়েছেন তাদের মধ্যেও এসব বিতরণ করা হবে। তবে পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা যদি ঠিক রাখতে পারি তাহলে এসব ভ্যাকসিন দরকার হবে না।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।