কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ ত্রাণ বিতরণে আরও শৃঙ্খলা আনতে মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। সেনাবাহিনীর তত্তাবধানে এই তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিকা তৈরির পর প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবারকে নিবন্ধিত ক্যাম্পের পরিবারগুলোর মতো বিশেষ কার্ড দেওয়া হবে। তখন ত্রাণ না পাওয়ার যেসব অভিযোগ কিছু কিছু রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে আসছে, তারাও সমান ত্রাণ পাবেন বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রশাসনের মুখপাত্র খালেদ মাহমুদ বলেন, প্রত্যেক রোহিঙ্গা সদস্য যারা এসেছেন তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ চলছে। পাশাপাশি আমরা পরিবারের তালিকা তৈরির কাজও শুরু করেছি। সেনাবাহিনী আসার পর তারা আমাদের তালিকা তৈরির কাছে সহযোগিতা করছেন। রোহিঙ্গাদের আমরা সুশৃঙ্খলভাবে একটা সিস্টেমের আওতায় আনতে চাচ্ছি।
মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে এই পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে এসেছে তার সঠিক হিসাবের জন্যও এই তালিকা জরুরি বলে মনে করেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতপালং, থাইংখালী, বালুখালী, টেকনাফের উনচিপ্রাং, বান্দরবানের তুমব্রুসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে গ্রামের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন।
এক সপ্তাহ আগেও ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছিল। কোন গাড়ি, হোক সেটা পাজেরো, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার কিংবা অটোরিকশা, দেখলেই ছুটে আসত শত, শত অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। দুই হাত পেতে আর্তি জানাত টাকার জন্য। কিংবা এতটুকু খাবারের জন্য। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান নিয়ে অনেকেই এসেছিল অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে। সড়কে চলতে চলতে ছুঁড়ে দিত বিস্কুটের প্যাকেট কিংবা পুরনো কাপড়। সেটা কুড়াতে গিয়ে হুড়োহুড়ি-মারামারি।
লাখো রোহিঙ্গার ঢল এবং ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা সামলাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিল প্রশাসন, তখন জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী।
চলতি সপ্তাহে উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ত্রাণ বিতরণের নামে সড়কে খাবার ছুঁড়ে দেওয়ার মতো কোন দৃশ্য চোখে পড়েনি। আবার নিয়ম না মেনে বড় বড় ত্রাণবাহী গাড়ি নিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসতিতে ঢুকে পড়ার মতো কোন দৃশ্যও চোখে পড়েনি।
বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন, সরকারিভাবে দেওয়া ত্রাণ সেনাবাহিনীর তত্তাবধানে সুশৃঙ্খলভাবে বিতরণ হতে দেখা যাচ্ছে।
তবে এখনো ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ আছে অনেক রোহিঙ্গার। বিশেষত দুর্গম পাহাড়ের মধ্যে যাদের বসতি অথবা যারা মূল সড়কের কাছাকাছিতে নেই তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে।
জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিবন্ধিত ক্যাম্প থেকে পুরনো রোহিঙ্গারা বেরিয়ে নতুন সেজে ত্রাণ হাতিয়ে নেওয়ার অনেক অভিযোগ তারা পেয়েছেন। আবার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে একই পরিবারের কয়েকজন ত্রাণ পেলেও অনেক পরিবারের কেউই পায়নি, এমন তথ্যও আছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ১০টি টিম করেও তেমন সুফল আসেনি।
ত্রাণ না পাওয়ার হাহাকার দেখা গেছে গত সোমবার ও বুধবার উখিয়ার কুতপালং ও বালুখালী এলাকায় গিয়ে। তবে তারা সংখ্যায় অনেক কম।
মিয়ানমারের মংডু জেলার ভুচিদং থেকে সাতদিন আগে আসা রইছউল্লাহ বলেন, দেরি করে এসেছি। সেজন্য বালুখালী পাহাড়ের সামনে জায়গা পাইনি। শেষদিকে যেখানে ঘর করেছি সেখানে দুইটা পাহাড় পার হয়ে যেতে হচ্ছে। সেখানে ত্রাণ নিয়ে কেউ যাচ্ছে না।
বলিবাজার এলাকা থেকে আসা মোহছেনার (১২) ঘরও বালুখালী পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। মোহছেনা জানায়, সাতদিন আগে এসে দুই চিড়া-মুড়ি ছাড়া আর কিছুই পায়নি। তবে সোমবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় বিতরণ করা ২৫ কেজি চাল মোহছেনাকে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সাতদিনে সেটাই প্রথম ত্রাণ বলে জানায় মোহছেনা।
ত্রাণ না পাওয়ার এসব অভিযোগ যেন আর না আসে সেজন্য রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.মঈনউদ্দিন।
তিনি বলেন, সব রোহিঙ্গাকে আমরা উখিয়ার বালুখালীতে নির্ধারিত দুই হাজার একর জায়গার মধ্যে নিয়ে যাব। সেখানে সেনাবাহিনী শেড তৈরির কাজ করছে। পরিবারের তালিকাও হচ্ছে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরিবারের তালিকা আমরা করছি। ইতোমধ্যে পরিবারকে দেওয়ার জন্য কার্ডও ছাপানোর কাজ শুরু হয়েছে।
‘পরিবারগুলো কার্ড নিয়ে জমা দেবেন জেলা প্রশাসনের ক্যাম্পে। সেখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের ত্রাণ দেওয়া হবে। তখন আর কোন অভিযোগ থাকবে বলে আমরা মনে করি না। ’
জেলা প্রশাসনের তত্তাবধানে ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উখিয়া ও টেকনাফে ১২টি ক্যাম্প করা হয়েছে। সেখানে ত্রাণ সংগ্রহের পাশাপাশি বিতরণের কাজও চলছে।
গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা একযোগে হামলা চালায়। এর জের ধরে মিয়ানমারে ব্যাপক সহিংসতার মুখে পড়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। নির্যাতনের মুখে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে তারা দলে দলে ছুটে আসতে শুরু করেন বাংলাদেশে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।