কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ কক্সবাজার শহরের বৈদ্যরঘোনা এলাকার বাসিন্দা ফরিদ আলম (৩৫) দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন তার কাজ নেই বললেই চলে। মাসের ২০ দিনই তাকে বেকার থাকতে হচ্ছে। রোহিঙ্গারা এসে এখানকার শ্রমবাজার দখল করে নেওয়ায় স্থানীয়দের হাতে কাজ নেই।
ফরিদ আলম জানান, শহরের সার্কিট হাউস সড়কের মোড়, টেকপাড়া, গোলদীঘির পাড়ে বসে শ্রমজীবীদের হাট। সেখানে সকালে গিয়ে বসলেই কাজ পাওয়া যেত। এখন এই বাজার দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গা শ্রমিকরা। ফলে স্থানীয় শ্রমিকরা আগের মতো আর কাজ পান না। তিনি বলেন, আগে দৈনিক ৫০০ টাকার নিচে কোনো দিন কাজ করতে হয়নি। এখন ৩০০ টাকায়ও কাজ পাওয়া যায় না। রোহিঙ্গা শ্রমিকরা তার চেয়েও কম দামে কাজ নিয়ে নেয়।
গতকাল সোমবার সকালে কক্সবাজার শহরের শহীদ সরণির মোড়ে পূবালী ব্যাংকের সামনে গিয়ে দেখা গেল শ্রমজীবীদের বিশাল হাট। কয়েকশ’ শ্রমিক সেখানে জড়ো হয়েছেন। খোঁজখবর নিতেই জানা গেল, ফরিদ আলমের কথাই সত্য। এখানে কাজের জন্য আসা শ্রমিকদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। বাগানে কাজের জন্য একজন শ্রমিকের মজুরি কত- জানতে চাইলে বললেন, ‘আপনার পছন্দমতো দেবেন।’ তার সঙ্গে দরাদরিতে যেতে হলো না। ঘিরে ধরল আরও অনেকে। সবার প্রত্যাশা কাজ, মজুরি নিয়ে ঝামেলা নেই।
শহরের গোলদীঘির পাড় এলাকায় শামসুল আলম নামের একজন রিকশাচালক জানালেন, কক্সবাজার শহরের ৯০ শতাংশ রিকশাচালক রোহিঙ্গা। জেলার সব স্থানে একই চিত্র। তারাই দখল করে নিয়েছে কৃষিশ্রমিক থেকে নানা পেশার মানুষের কাজ।
এদিকে, কাজের দাবিতে উখিয়ায় মানববন্ধন করেছে ‘অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে একটি সংগঠন। গতকাল বিকেলে কোর্টবাজার স্টেশনে এই মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা বেকার হয়ে পড়ছেন।
কক্সবাজার মাছ ধরার বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোসতাক আহমদ স্বীকার করে জানান, বঙ্গোপসাগরে বেশির ভাগ বোটের মাঝিমাল্লা এখন রোহিঙ্গা। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি বলে জানালেন বোট মালিক। তিনি বলেন, স্থানীয়দের তুলনায় অর্ধেক দামে জেলে শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই সবারই এখন রোহিঙ্গা শ্রমিকদের প্রতি আগ্রহ বেশি।
কক্সবাজার জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শফি উল্লাহ আনচারী জানান, হোটেল-মোটেলসহ বিভিম্ন শ্রম পেশায় এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যাই বেশি। কম মজুরির কারণে তারা কাজ পাচ্ছে। অনেকে পরিচয় গোপন করে কাজে ঢুকে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ তৈরি হবে।
কক্সবাজার ও বান্দরবানের ব্যাপক বনজ সম্পদ রোহিঙ্গারা উজাড় করে দিয়েছে। বনের কাঠ কেটে তারা জীবিকা নির্বাহ করছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আলী কবির জানান, রোহিঙ্গাদের কারণে এখন বনসম্পদ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নির্বিচারে তারা পাহাড় কাটছে, বৃক্ষ নিধন করছে। এভাবে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটা হলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বাড়ছে দ্রব্যমূল্য : কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বাঁশ, কাঠ, ছন, পলিথিনসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য। কয়েক লাখ রোহিঙ্গার কারণে এখানে নির্মাণসামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে। বেড়ে যাচ্ছে মাছ-সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম। ফলে স্থানীয়রা পড়েছে চরম বেকায়দায়। উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরী জানান, উখিয়ার হাটবাজারে আগে এক কেজি করলা বিক্রি হতো ২০ টাকায়। এখন এক কেজি করলা ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। বিপুলসংখ্যক মানুষের চাহিদার কারণে বেড়ে গেছে চাল, ডাল, তেলসহ বিভিম্ন নিত্যদ্রব্যের দাম। প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা।
বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা : রোহিঙ্গাদের মধ্যে সুষ্ঠু ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ব্যবহূত হচ্ছে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে সেখানে বন্ধ রয়েছে পাঠদান। কুতুপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে লঙ্গরখানা। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিদিন খাবার রাম্না হচ্ছে। বালুখালী কাসেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। বিদ্যালয় ভবনে রাখা হয়েছে ত্রাণসামগ্রী। একইভাবে গুনদুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, থাইনখালী দাখিল মাদ্রাসা, বালুখালী দাখিল মাদ্রাসাসহ আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ রোহিঙ্গাদের কারণে। উখিয়া ও টেকনাফে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চরম ব্যাহত হচ্ছে।
উখিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক রায়হান উদ্দিন জানান, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কখন নিজ দেশে ফিরে যাবে, তা অনিশ্চিত। এভাবে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাতে মারাত্মক ক্ষতি হবে শিক্ষার্থীদের।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে অনেক ভোগান্তি সহ্য করছেন স্থানীয়রা। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে লোকসংখ্যা মাত্র ৫০ হাজার। সেখানে এখন পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পর কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে, কেউ বুঝতে চাইছে না। তিনি আরও বলেন, এখানে চাহিদামতো নিত্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে।
সূত্র- সমকাল
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।