বৈশ্বিক দুনিয়ার আদমশুমারী উদ্ধৃতি অনুসারে এপার বাংলার বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্র জনসংখ্যার দিক দিয়ে মিয়ানমার ২৪তম দেশ। এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৭% বৌদ্ধ, ৬% খ্রীষ্টান, ৪.৩% মুসলিম। বাকী অংশ হিন্দু, নাস্তিক এবং উপজাতীয় কিছু ধর্মের লোক বসবাস করেন। মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে অধিকাংশই বর্মী মুসলিম, যাঁরা ইয়াংগুনে বসবাস করেন। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি উপজাতীয় মুসলিম সম্প্রদায়, (যেমন : রোহিঙ্গা, পান্তুই, মালোয়, জেরবাদী মুসলিম)। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপরই অমানবিক নির্যাতন হয় বেশি। যাঁরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৩% । বাকী মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের খবর শোনা যায়না তেমন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ধর্মের চেয়েও এখানে মুর্খ্য বিষয় হচ্ছে বর্মী এবং রোহিঙ্গাদের বৈরীতার পূর্ব ইতিহাস।
রোহিঙ্গা কারা,কেন শরনার্থী ?
বর্তমানে মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাদের কর্থ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছেন। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে একটি জাহাজ ডুবে গিয়েছিলেন। এই জাহাজ থেকে যারা সাঁতরে আরাকান উপকূলে আশ্রয় নেই, তাদেরকেই রোহিঙ্গা মনে করা হয়। আল্লাহর রহমতে বেঁচে ছিলেন বলেই আজ তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হিসেবে বসবাস করছেন।
ইতিহাস বলে ১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায়ই ২২হাজার বর্গমাইল এলাকা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। ঠিক ঐ সময়ে রচিত বাংলা সাহিত্যিকদের রচনায়ও ‘রোসাং ‘ রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর বর্মী ‘বোদাওফায়া’ যখন এই রাজ্যে দখল করে, তখন থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন।কালক্রমে ব্রিটিশরা মিয়ানমারে উপনিবেশ স্থাপন করেন। তাঁরা তখন মিয়ানমারের প্রায়ই ১৩৯ টি নৃ-গোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশদের অনেক বড় বড় ভুলের মধ্যে আরেকটি বড় ভুল হলো, এই তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত না করা। ফলে, রোহিঙ্গা নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। ১৯৪৮সালে মিয়ানমার যখন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন এই নির্যাতন অনেকাংশ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তৎকালিন সরকারের উচ্চপদস্হে রোহিঙ্গাদের স্থান ছিল। কিন্তু, ১৯৬৮ সালে ‘নে উইন ‘ এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর আবার শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হচ্ছেন ‘রোহিঙ্গা ‘। তাদের জাতিগত স্বীকৃতি নেই, শিক্ষার অধিকার নেই ,মানবিক অধিকার নেই,এমনকি বিয়ে করার বৈধতা পর্যন্ত নেই, নেই তাদের সন্তান জন্মদানের অধিকার। অথচ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন।পশুর মত জীবন দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়তেই। সম্প্রতি এই নির্যাতন অবর্ণনীয় মাত্রা ছেড়ে গেছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার ও শরনার্থী বিষয়ক সংগঠন ‘UNHCR’ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।শরনার্থী বিষয়ে বৈশ্বিক ভৌগলিক অবস্থান ভেদে আন্তজার্তিক সনদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মর্যাদা অগ্রগণ্য। বিশ্বের যেকোন দেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানবিক কদর সর্বোচ্চ।মগের মুল্লুকে ম্রিয়মান সংঘলু রোহিঙ্গা আদি নিবাস মিয়ানমার জান্তা সরকারের কাছে বরাবরই সংকটের আর্বতে চরম এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মুখোমুখি জীবনযাপন অতিবাহিত হয়েছে। আবাসস্থল থেকে শুধু বিতাড়ন নয় সুদুর প্রসারি পরিকল্পনা মতে একেবারেই উচ্ছেদের কাজে লিপ্ত জান্তা সরকার।বরাবরের মত তারা আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়ার. হীনমন্যতা নানা জাতিগত সংঘাতে এপার বাংলায় রোহিঙ্গা রপ্তানি করণে ব্যস্ত।কিন্তু বাংলাদেশ সাময়িক আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছেন। পূর্বেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে কোন সুরহা হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায়ই ৪লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা আশ্রয়ে আছে। অথচ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এবং বিশ্ব প্রতিনিধিরা যদি মিয়ানমারকে এই ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতেন, রোহিঙ্গাদের জন্য একটি দীর্ঘ (২৫-৩০ বছরের) কর্মকৌশল নির্ধারণ করতেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বৈধতা এবং সম্প্রদায়টির জাতিগত স্বীকৃতির উদ্যোগ গ্রহণ করতেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই এই সমস্যাটি সমাধানের পথ খুঁজে পেতেন। পক্ষান্তরে, সবসময় বাংলাদেশের সীমানায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের উদ্যোগ নিলে তা বিশাল জনগোষ্ঠীর এই ক্ষুদ্র আয়তনের দেশের জন্য হিমালয়তুল্য চাপ হয়ে যায়, সাথে সাথে বৈরীতায় রূপ নেয় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক।
বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ।এই কষ্ট বাংলাদেশই বুঝেন। এর কুফল বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীয় ভোগ করেন।এরপরও রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের আপত্তি নেই। কিন্তু, পরবর্তীতে এই শরনার্থীদের ব্যাপারে কোনো সুরহা না হলে, সেটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও বড় হুমকীস্বরূপ। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ভারতে শরনারথী আশ্রয় এর সাথে রোহিঙ্গা আশ্রয় কে তুলনা করা হয়।তবে একটা ব্যাপার হল আমরা ভারতে আশ্রয় নিয়ে কিন্তু চুরি, ডাকাতি, হত্যা,লুন্ঠন কিংবা মাদক ব্যাবসা করি নাই যেটা অনেক রোহিঙ্গারা আমাদের বাংলাদেশ এ আশ্রয় নিয়ে করে থাকেন।যার কুফল কিন্তুু ভোগ করতে হয় এদেশের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ কে। এই জায়গায় আমাদের সাথে রোহিঙ্গা শরনার্থী আশ্রয় নেয়ার মৌলিক পার্থক্য।তবোও বলব ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করে অতীতে মানবতা দেখানো বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে মানবিক আচরণ করা নৈতিক দায়িত্ব।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি নিষ্টুর মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বেশ কিছু গঠনমূলক কাজের দায়িত্ব রয়েছে এই নিন্দনীয় রোহিঙ্গা নির্যাতনের এর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সরকার দেশবাসী কে সাথে নিয়ে জাতিসংঘ, ও.আই.সি, আসিয়ান সহ সকল আন্তর্জাতিক লেভেলে রোহিঙ্গা টর্চার ইস্যু টা কে নিয়ে গঠনমুলক আলোচনা করতে পারেন। বাংলাদেশস্হ মিয়ানমার রাস্ট্রদুত কে ডেকে কড়া প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানাতে পারেন।প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এইটা বাংলাদেশের নৈতিক দায়িত্ব।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন ও বিনা বিচারে এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন এবং আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত। করতেই হবে মানবতার দৃষ্টিতে।কারন রোহিঙ্গারা মানবতার উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত এই দেশে এসেই বুঝতে পারেন যে, আসলে মানবতা,জাতীয়তা,স্বাধীনতা সর্বোপরি অধিকার কি জিনিস।তাই আন্তর্জাতিক শরনার্থী সনদে মিয়ানমার বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক জীবন যাপনের সুন্দর আবাস সৃষ্টি অপরিহার্য। বিশ্ব মুল্লুকে নানা গোত্রের, বর্ণের যে সকল জাতি জন্ম – আমৃত্যু বসবাস করছে? ঠিক তেমনি নুন্যতম সকীয় আবাসভুমি সৃজন হউক রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার শেষ অনুকরণ। রোহিঙ্গা ভেবে নয়। মানবের কল্যাণে উদ্ভাসিত হউক আগামীর রোহিঙ্গা বিপ্লব। সমগ্র পৃথিবী আজ রোহিঙ্গা বিষয়ে নির্বাক।স্তমিত।এমনটি আমরা চাই না। জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের সকীয় ধারা প্রসারিত হউক এই প্রত্যাশা সকল মানবের। জসিম মাহমুদ ছাত্র,সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, চট্রগ্রাম। সম্পাদনায়,শ.ম.গফুর,সংবাদকর্মী
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।