আবদুল আজিজ,(বাংলাট্রিবিউন): বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাসের পরও জ্বলছে রাখাইন রাজ্য। প্রতিদিন ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কারণে রোহিঙ্গারা এখনো পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, রাখাইনে মিয়ানমার সেনা বাহিনী মাইকিং করে বাংলাদেশে চলে আসার নির্দেশনা দিচ্ছে। একইভাবে প্রতিটি গ্রাম মহল্লায় তল্লাশী অব্যাহত রেখেছে। যারা নিজের ভিটে বাড়ির টানে এখনো রাখাইনের জঙ্গলে লুকিয়ে অবস্থান নিয়েছিল, তারাও আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে।
গত দুই দিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনো বিচ্ছিন্নভাবে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে রাখাইনে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর। এ নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারি স্থানীয়রা এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে নতুন কিছু উদ্বেগ দেখা যায়নি। কারণ প্রতিদিন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আত্মচিৎকার, নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা ও আহত নিহতের কথা শুনতে শুনতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেন তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। বিভিন্ন সূত্রমতে গত দুইদিনে প্রায় সাড়ে ৩হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, লম্বাবিল ও উখিয়ার পালংখালীর ধামনখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিয়াংমং ও নাফপুরা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা যুবক শাহা আলম ও মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে এক সাথে ৫০ জন নারী ও শিশু সহ বাংলাদেশে এসেছেন। কারণ মিয়ানামারের সেনা বাহিনী ও মগরা প্রতিদিন মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার নির্দেশনা দিচ্ছে। যদি এক সপ্তাহের মধ্যে রাখাইনে কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘোষনা দেয়া হয়েছে’।
টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ নাফ নদীর পার হয়ে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গা বৃদ্ধা ছলেমা খাতুন বলেন, ‘আমার বাড়ি মিয়ানমারের শীলখালী গ্রামে। রাখাইনে সহিংসতার পরও কোন রকম না খেয়ে পালিয়ে ছিলাম। এরমধ্যে গত এক সপ্তাহ আগে স্বামী বদিউল আলম নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু, গত রোববার রাখাইনে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও মগরা এসে মাইকিং করে চলে আসার নির্দেশনা দেয়। এ কারণে অন্যান্যদের সাথে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।
আজ মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার গ্রাম থেকে এসেছেন মোহাম্মদ হোসেন ও ফাতেমা বেগম দম্পতি জানিয়েছেন কোন ভাবে রাখাইনে থাকা সম্ভব নয়। নানা সহিংসতার পরও কোন সময়ে তারা বাংলাদেশে আসেনি। এবারও থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু, সেনাবাহিনীর এতে তৎপরতা ও ভয়াবহ টহলের কারণে চলে আসতে বাধ্য হলাম। প্রতিদিন সেনাবাহিনী ও মগরা গ্রামে বিভিন্ন এলাকা তল্লাশী শুরু করে এবং খালি পড়ে থাকা বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
একইভাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া, তুমব্রু, কুমিরখালী, শীলখাল, কিয়াংমং, বলিবাজার, বুচিডং, নাফপুরা সহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে টেকনাফের লেদা, উনচিপ্রাং, উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু। এসব রোহিঙ্গা নারী, পুরুষদের অনেকে বলেছেন, তাদের দুর্দশার কথা। এক পর্যায়ে এ প্রতিবেদক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার কথা জানানো হলে এসব রোহিঙ্গা বিশ্বাস করতে চায় না। এটি একটি মিয়ানমারের মিথ্যার আশ্রয় ও রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করেন।
এদিকে, টেকনাফ উপজেলার উনচিপ্রাং সীমান্তে বসবাসকারি স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক তাহের নঈম জানান, ‘আজ সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইনের কুমিরখালী ও শীলখালী এলাকায় একের পর এক গ্রাম জ্বলতে দেখা গেছে। এই দৃশ্য স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারি সংস্থাও অবলোকন করেছেন। এ কারণে মিয়ানমারের অভ্যান্তরে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে দেখা গেছে’।
টেকনাফের হোয়াক্যং উলুবনিয়া সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ নুর আহমদ জানান, ‘মিয়ানমার সরকার কোন সময় কি বলে তার কোন হিসাব নেই। তারা কোন বিষয়ে চাপে পড়লে হঠাৎ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কারণ মিয়ানমার একদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছেন, অন্যদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় আমি অবাক হয়নি। এটি তাদের নীতি। তাই, আরো কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে মিয়ানমারকে চাপে ফেলতে হবে’।
প্রসঙ্গ, সোমবার বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের এক বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। একই সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে একটি চুক্তির খসড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, সন্ত্রাসের ব্যাপারে আমরা সব সময় জিরো টলারেন্স দেখিয়ে আসছি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।