আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ প্রত্যাবাসন উদ্যোগের মধ্যে এখনো শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল সোমবার মন্ত্রণালয় বলেছে, গত রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাখাইন রাজ্য কর্তৃপক্ষ মংডুতে ৮৫৩ জন রোহিঙ্গাকে দেখতে পেয়েছে।
ওই রোহিঙ্গারা বুথিডংয়ের বাসিন্দা। তারা পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে।
এদিকে ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট থেকে শনিবার পর্যন্ত ছয় লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রত্যাবাসনবিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডাব্লিউজি) গঠনের বিষয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এবং গত ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি নেপিডোতে জেডাব্লিউজির প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে জোরালো আহ্বান জানিয়েছিল। এখনো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসা অব্যাহত থাকাই প্রমাণ করে যে মিয়ানমার তাদের দেশত্যাগ ঠেকানোর চেষ্টা করছে না বা চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরুর লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করছে। প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত করতে ওই সংস্থাটির সঙ্গে সমঝোতা সইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের তথ্য আদান-প্রদানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল; কিন্তু প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।
কিন্তু এখনো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত থাকায় সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের এই বার্তা দিচ্ছে যে রাখাইন রাজ্যে তাদের (রোহিঙ্গাদের) থাকার মতো আর পরিবেশ নেই।
রোহিঙ্গারা এখনো কেন মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসছে তার কারণ জানে না আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত পরামর্শক কমিশন। ওই কমিশনের প্রধান ও থাইল্যান্ডের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. সুরাকিয়া সিতিয়ানথাই রাখাইন রাজ্য সফরের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সেখানে কোনো ঝুঁকি নেই। সফরের সময় গ্রামবাসীর চোখে-মুখে আমি কোনো ভয়ভীতি দেখিনি। ’
রাখাইন রাজ্যবিষয়ক সংবাদ বিবরণীতে গতকাল সোমবার বলা হয়েছে, সুরাকিয়া সিতিয়ানথাইয়ের নেতৃত্বে পরামর্শক কমিশন গত সপ্তাহে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এর আগেই কমিশন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায়।
সিতিয়ানথাই মিয়ানমারে সাংবাদিকদের বলেন, হেলিকপ্টার থেকে তিনি রাখাইন রাজ্যে উর্বর ভূমি, শস্যক্ষেত, প্রচুর পানি—সব মিলিয়ে বিশাল সম্ভাবনা দেখেছেন। সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, পোশাক শিল্প-কারখানা চালু করা হলে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
তিনি বলেন, কিয়াউকপিউতে যাওয়ার সময় সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনা তাঁরা দেখতে পেয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রথমবারের মতো তাঁর এই মিয়ানমার সফর বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। তিনি ও কমিশনের অন্য সদস্যরা মিয়ানমারের উন্নতি এবং সংঘাতের চিহ্ন—দুটোই দেখেছেন। তবে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
সিতিয়ানথাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন রাজ্যের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও আমলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরামর্শক কমিশন কোনো সরকারকে বিচারের জন্য চাপ দিতে বা উদ্বুদ্ধ করতে পারে না।
তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার সরকার কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য গত ১৪ ডিসেম্বর যে পরামর্শক কমিশন গঠন করেছে তাতে সু চির আস্থাভাজনদেরই স্থান মিলেছে। ১০ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিশনের পাঁচজন বিদেশি। ইতিমধ্যে তাঁদের একজন মতপার্থক্যের কারণে পদত্যাগ করেছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরো জানায়, সিতিয়ানথাই রাখাইন রাজ্য সফরে গিয়ে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন সেটিকেও সাম্প্রতিক বছরের রোহিঙ্গা সংকটের কারণ হিসেবে অনেকে মনে করে থাকেন। অভিযোগ আছে, রাখাইন রাজ্যে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার (বিশেষ দূত) ইয়াংহি লি তাঁর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা আগামী বৃহস্পতিবার সিউলে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে। সু চির সরকার ইয়াংহি লিকে মিয়ানমারে ঢুকতে দেয়নি। তারা তাঁকে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার ঘোষণা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিতে তিনি গত ১৮ থেকে ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর তিনি থাইল্যান্ডে যান। তাঁর থাইল্যান্ড সফর আজ শেষ হচ্ছে।
ইয়াংহি লি বাংলাদেশ সফরকালে বেশির ভাগ সময় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করে তাদের ওপর দুঃসহ নির্যাতন-নিপীড়নের কথা শুনেছেন। আগামী মার্চ মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে তিনি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।