উখিয়া ও টেকনাফে গড়ে ওঠা তিনটি অনিবন্ধিত শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অভাব-অনটন ও থাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তারা শিবির ছেড়ে যাচ্ছে বলে জানান রোহিঙ্গা নেতারা। তারা কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী এবং টেকনাফের লেদায় এ তিনটি িশবিরের অবস্থান।
এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শুমারিতেও রোহিঙ্গাদের আগ্রহ কম। ২ মার্চ সকালে উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে রোহিঙ্গাদের গণনা করছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর নিয়োগপ্রাপ্ত গণনাকারীরা। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাদের তেমন আগ্রহ নেই। বিশেষ করে ছবি তুলতে রাজি হচ্ছেন না। রোহিঙ্গাদের ধারণা, শুমারির পর তাদের ঠেঙ্গারচরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
শিবিরের আমতলী পয়েন্টে দেখা গেছে, টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক অংশে জড়ো হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। তারা সেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। বাস এলে রোহিঙ্গা তাতে উঠছে। তারপর চলে যাচ্ছে কক্সবাজার শহরের দিকে। রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নজরদারি কিংবা যাতায়াত বন্ধে সেখানে কেউ নেই।
শিবির ত্যাগের কারণ জানতে চাইলে রাখাইন রাজ্যের গজরবিল গ্রাম থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে পালিয়ে আসা দিল মোহাম্মদ (৪৮) বলেন, ‘শিবিরের ১৬ ফুটের একটি ঝুপড়িতে চার পরিবার গাদাগাদি করে থেকেছি। এতে অনেক সমস্যা। তা ছাড়া আয়–রোজগার না থাকায় ঠিকমতো খাওয়াও হচ্ছে না। তাই পরিবার নিয়ে কক্সবাজার শহরে চলে যাচ্ছি। সেখানে মাছ ধরার ট্রলারে শ্রমিকের কাজ আছে। দৈনিক ৫০০ টাকা পেলে সংসার চলে যাবে।’
আরেক রোহিঙ্গা কামাল উদ্দিন (৩৪) বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নাকি ঠেঙ্গারচরে পাঠানো হচ্ছে। তাই কক্সবাজারে চলে যাচ্ছি। সেখানকার ঘোনাপাড়া পাহাড়ে বহু রোহিঙ্গার বসতি আছে, সেখানে থাকব।’
কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, এই শিবিরে নতুন–পুরোনো মিলে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। মালয়েশিয়া থেকে পাঠানো ত্রাণের আশায় বাইরে অবস্থান করা কিছু রোহিঙ্গা এই শিবিরে ঢুকেছিল। এখন ত্রাণ না পেয়ে তারা ফিরে যাচ্ছে। তা ছাড়া আরও কিছু রোহিঙ্গা অন্যত্র চলে গেছে। কারণ, এই শিবিরের থাকা–খাওয়ার সমস্যা। আয়–রোজগারও নেই। তার ওপর সবার মনে ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর আতঙ্ক কাজ করছে।
এ ব্যাপারে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে অনিবন্ধিত শিবিরে ওঠে। এরপর অন্য স্থানে চলে যায়। প্রতিদিন এভাবে অনেকে চলে যাচ্ছে। এদের ওপর নজরদারি রাখা কঠিন। কারণ, শিবিরে সীমানাপ্রাচীর নেই। যার খুশি ঢুকে পড়ে কিংবা বেরিয়ে যায়। তবে রোহিঙ্গারা যেখানেই থাকুক গণনার আওতায় আসবে।
রোহিঙ্গারা শিবির ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা স্বীকার করেন টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিনও। তিনি বলেন, অল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া জানান, আয়–রোজগারের জন্য বহু রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. ওয়াহিদুর রহমান বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে রোহিঙ্গা শুমারি শুরু হয়েছে। জেলার উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু ও চকরিয়া উপজেলায় ১০ মার্চ পর্যন্ত ১১ দিনের এই শুমারি চলবে। এ জন্য ২০০টি দল মাঠে নামানো হয়েছে। প্রতিটি দলে আছেন একজন সুপারভাইজার ও একজন গণনাকারী। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সম্প্রতি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্ত করতেই এই শুমারি।
তিনি আরও জানান, মিয়ানমার থেকে আসা ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা থাকে উখিয়া ও টেকনাফের শিবিরে। এ ছাড়া শিবির ছেড়ে গেলেও তারা কক্সবাজারের বাইরে যাচ্ছে না। কক্সবাজারে তারা যেসব জায়গায় যাচ্ছে সেখানেও শুমারি হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গারা যেখানেই থাকুক শুমারির আওতায় আসবে।
উখিয়া উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা নুরুল কবির বলেন, ২০১৬ সালের ২ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শুমারি করা হয়েছিল। ওই সময় যারা বাদ পড়েছিল, এবারের শুমারিতে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ও পার্শ্ববর্তী বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের কোনোটিতে সীমানাপ্রাচীর বা কঁাটাতারের বেড়া নেই। রোহিঙ্গারা যখন ইচ্ছা ঢুকতে পারে। চলে যেতেও সমস্যা নেই। এতে শুমারি কাজে কিছুটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতা দরকার। রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের সহযোগিতা না পেলে বসবাসের সুযোগ পাবে না।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা শুমারি সফল হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট কোনো বসতি নেই। টেকনাফ ও উখিয়ার কয়েকটি শিবিরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করলেও অনেকে শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। উপকূলে চিংড়ি পোনা আহরণ ও মাছ ধরার ট্রলারে জেলে শ্রমিকের কাজ করছে। শহরে রিকশা ও টমটম চালনোসহ লোকজনের বাসাবাড়িতে রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়েছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা শুমারি হয়েছিল। কিন্তু এখনো ওই শুমারির ফলাফল ঘোষণা হয়নি। তাই নতুন রোহিঙ্গা শুমারি নিয়ে কারও তেমন আগ্রহ নেই। গণনার আগে রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় এনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি।
এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উখিয়া সদরের একরাম মার্কেট চত্বরে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো এবং ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের দাবিতে গণসমাবেশ করে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি’। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আলিম ফকিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনছুর চৌধুরী, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ সিকদার, উখিয়া প্রেসক্লাব সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সমাবেশে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের খবরে তারা শিবির ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। অন্যথায় সমাজের সঙ্গে মিশে গেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।